বিশ্ব শিক্ষা দিবস: যশোরসহ ১০ জেলায় শিক্ষার মান নিম্নে

দৈনিকশিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

দৈনিকশিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: আজ বুধবার আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারি পালিত হয় দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য ‘টেকসই শান্তির জন্য শিক্ষা’। এ বছর ষষ্ঠবারের মতো পালিত হচ্ছে দিবসটি। 

এক সময় দেশের জেলাগুলোর মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক থেকে সামনের সারিতে ছিল যশোর। স্বাধীনতার আগে-পরেও এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয়েছে বৃহত্তর যশোর, খুলনা, বরিশাল ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের শিক্ষা কার্যক্রম। দীর্ঘদিন অঞ্চলগুলোর শিক্ষার মান উন্নয়নের কাজটি হয়েছে ১৯৬৩ সালে স্থাপিত যশোর শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে। বর্তমানে সে অগ্রসর অবস্থান অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে জেলাটি। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার মানের দিক থেকে এখন দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর একটি যশোর।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন-২০২২-এ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার (পারফরম্যান্স) দিক থেকে জেলাটির অবস্থান নেমে এসেছে ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১তমে। এদিক থেকে যশোরের পাশাপাশি সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বান্দরবান, কুড়িগ্রাম ও রাজবাড়ীর শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য জেলার মধ্যে নড়াইল, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও বগুড়ার প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পঠন দক্ষতাও খুব একটা ভালো নয় বলে অধিদপ্তরের মূল্যায়নের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে। 

বিভিন্ন জেলার তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বাংলা ও গণিতের দক্ষতা নিয়ে পাঁচ বছর পরপর এ মূল্যায়ন চালায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ। এতে পঠন দক্ষতা, সাবলীল পাঠসহ বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনার ভিত্তিতে জেলাগুলোর শিক্ষার্থীদের স্কোরিং করা হয়। মূল্যায়নের পর স্কোরিংয়ে জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বাংলা ও গণিতে গড় দক্ষতা মান এসেছে যথাক্রমে ১০৩ দশমিক ৩ এবং ১০৪ দশমিক ১। আর দেশের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বাংলা ও গণিতে গড় দক্ষতা মান পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১১০ দশমিক ২ ও ১১৩ দশমিক ৩। 

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, মূল্যায়নে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীর বাংলার ক্ষেত্রে দেশের প্রায় অর্ধেক জেলার শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান এসেছে জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। এছাড়া পঞ্চম শ্রেণীর গণিতের ক্ষেত্রে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জেলার শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা জাতীয় গড় দক্ষতার তুলনায় কম। বিশেষ করে বান্দরবান, কুড়িগ্রাম, যশোর, রাজবাড়ী, নড়াইল, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও বগুড়ার অবস্থা এদিক থেকে খুবই হতাশাব্যঞ্জক।

এর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বান্দরবান। এ জেলার শিক্ষার্থীদের বাংলা ও গণিতের গড় দক্ষতা মান ১০০-এর নিচে। এদের মধ্যে বাংলায় তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ৮৮ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ৯৯। অন্যদিকে গণিতে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ৮৯ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ১০১। জেলার শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্গম এলাকা, শিক্ষক সংকট এবং সুযোগ-সুবিধার ঘাটতির কারণে এ জেলার শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা তুলনামূলক খারাপ।

বান্দরবান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‌দুর্গম এলাকা হওয়ায় এখানে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক সংকট রয়েছে। আবার অভিভাবকদেরও অনেকে সচেতন নন। শিক্ষার্থীদের একাংশ নিয়মিত উপস্থিত হয় না। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা তুলনামূলক খারাপ।’

বান্দরবানের মতো কুড়িগ্রামেও শিক্ষার্থীদের বাংলা ও গণিতের গড় দক্ষতা মান ১০০-এর নিচে। এ জেলায় বাংলায় তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ৯৩ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ৯৯। অন্যদিকে গণিতে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ৯৭ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ১০৮।

যশোরে বাংলায় তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ৯৪ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ১০৩। অন্যদিকে গণিতে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ৯২ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান ১০৭।

১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘‌যশোর জেলা শহরের শিক্ষার মান বেশ ভালো। তবে গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে থাকতে পারে। এখন অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট রয়েছে, আবার অভিভাবকরাও তেমন সচেতন নন। দেখা যায় শিক্ষার্থীরা বাসায় তেমন পড়ালেখা করে না। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের যে দক্ষতা, যেটি মূলত চর্চানির্ভর সেটি তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে না। এ ঘাটতির প্রভাবই পরবর্তী সময়ে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীতে থেকে যায়।’

অন্যান্য জেলার মধ্যে বাংলায় তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান যথাক্রমে রাজবাড়ীতে ৯৪ ও ১০৩, নড়াইলে ৯৫ ও ১০৩, ঝিনাইদহে ৯৫ ও ১০৪, জয়পুরহাটে ৯৭ ও ১০১, সুনামগঞ্জে ৯৭ ও ১০৩, সিলেটে ৯৬ ও ১০৪ এবং বগুড়ায় ৯৬ ও ১০৭।

গণিতের ক্ষেত্রে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা যথাক্রমে রাজবাড়ীতে ৯৫ ও ১০৬, নড়াইলে ৯৭ ও ১০৪, ঝিনাইদহে ৯৫ ও ১০৭, জয়পুরহাটে ৯৭ ও ১০৭, সুনামগঞ্জে ৯৭ ও ১০৬, সিলেটে ৯৬ ও ১০৭ এবং বগুড়ায় ৯৬ ও ১০৭।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন,  দারিদ্র্য, শিশুশ্রম, শিক্ষক সংকট এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ঘাটতি এসব জেলার শিক্ষার্থীদের মান খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ। সুনামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফয়জুর রহমান বলেন, ‘‌হাওর অঞ্চলের একটা বড় সমস্যা দারিদ্র্য। এসব এলাকায় মানুষের প্রধান জীবিকা মাছ ধরা ও ধান চাষ। অধিকাংশ সময় দেখা যায় বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুরা মাছ ধরতে যায় এবং নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে না। আবার ধান কাটার মৌসুমেও একই ঘটনা ঘটে। এছাড়া হাওর অঞ্চলে শিক্ষকস্বল্পতা প্রকট এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার কম। আর এ সবগুলোর কারণেই শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা খারাপ হয়।’

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ হারের বিষয়টি ফুটে উঠেছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিবেদন-২০২২-এও। প্রতিবেদন অনুযায়ী এ ১০ জেলার অধিকাংশেই ৩৫ থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণহীন। এদের মধ্যে বান্দরবানে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার সবচেয়ে কম। এ জেলায় মাত্র ৩৮ দশমিক ৬১ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষিত। এছাড়া কুড়িগ্রামে ৫৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যশোরে ৬০ দশমিক ৬০, রাজবাড়ীতে ৬৪ দশমিক ৩২, নড়াইলে ৬১ দশমিক ৭৭, ঝিনাইদহে ৫৯ দশমিক শূন্য ৯, জয়পুরহাটে ৬৪ দশমিক ৪৮, সুনামগঞ্জে ৬০ দশমিক ৫৩, সিলেটে ৭১ দশমিক ৯২ ও বগুড়ায় ৬৩ দশমিক ২৩ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষিত।

প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার মান বাড়াতে অংশীজনদের সঙ্গে সমন্বয়, মনিটরিং বৃদ্ধি, শিক্ষক সংকট দূরীকরণ এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন এ শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘‌প্রাথমিক শিক্ষা হলো শিক্ষার ভিত। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলে পরবর্তী সময়ে তা পূরণ কঠিন। আর এ ঘাটতি দূর করতে হলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ শিক্ষার অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। শিক্ষক যা শেখাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা তা যথাযথভাবে শিখছে কিনা তা লক্ষ রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষকরা প্রশিক্ষণে যা শেখেন ক্লাসে তার যথাযথ প্রয়োগ করেন না। এটি নিশ্চিত করতে মনিটরিং বাড়াতে হবে। এছাড়া সারা দেশেই শিক্ষক সংকট দূর করতে হবে। এখন হয়তো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত কম, তবে এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে ৭০ জনের বিপরীতে শিক্ষক একজন। এগুলো দূর করতে হবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038180351257324