বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষ জনশক্তি সরবরাহে ব্যর্থ

দেলোয়ার জাহিদ |

কভিডজনিত পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের অতিমারি থেকে উত্তরনের পথ এবং  শিক্ষার টেকসই উন্নয়ন কর্মকৌশল নিয়ে  বোদ্ধা মহলে নানাহ আলোচনা ও  বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নমুখী দেশগুলোতে  দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট । এখানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের গতি নিম্নগামী । উচ্চশিক্ষা ও উদ্ভাবনী গবেষণায় রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা,  রয়েছে কৌশলগত কারণে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার অপারগতা। যার কারণে আশানূরূপ  জ্ঞান ভিত্তিক অর্থনীতি ও দক্ষ জনশক্তি  গড়ে উঠছে না।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের  ২০০ বছর ও পাকিস্তানি শোষণ-নিপীড়ন, বঞ্চনা ও শিক্ষা সংকোচনের  ২৩ বছর বাঙালি জাতিকে পশ্চাৎপদ করে রেখেছিলো। জাতির উন্নতির চাবিকাঠি শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই  ছিল পিছিয়ে । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর শিক্ষার অগ্রগতির  দিকে নজর দেন।  বঙ্গবন্ধু  বিশ্বাস করতেন পিছিয়ে পড়া বাঙালি জাতির উন্নয়ন  সুষম শিক্ষা ছাড়া  কখনোই  উন্নতি সম্ভব  নয়। মেধা ও মননে আধুনিক ও  চিন্তা-চেতনায় প্রাগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। সে উপলব্ধি থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু একসঙ্গে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এক লাখ ৬২ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রায় পাঁচ দশকেও কোনো শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। একটি স্বাধীন দেশের চাহিদার আলোকে ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা কমিশন প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সুপারিশ করে। সে অনুসারে শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার এ ক্ষেত্র'এ   সকল অর্জনকে  ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, লক্ষ্য ও চেতনাকে নস্যাৎ করার অভিপ্রায়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ৭২এর পর ছয়টি শিক্ষানীতি রিপোর্ট প্রণীত হলেও এগুলো  বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

২০০৯ সনের জানুয়ারি মাসে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সরকার প্রতিষ্ঠার পর ভিশন-২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হয়। দায়িত্ব গ্রহণের অব্যবহিত পরেই বর্তমান সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষানীতি প্রণয়নও তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করে । তবে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বর্তমান  শিক্ষা-কার্যক্রমকে আরো সময় ও যুগ উপযোগী  করে গড়ে তোলা দরকার।

বাংলাদেশে টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষা-কার্যক্রমকে যুগ উপযোগী  করে ঢেলে সাজানো ও প্রাসংঙ্গিক বিষয়াদির গুণগত মানোন্নয়নের প্রচেষ্টা এখনো  খুবই  সীমিত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে দেশের তৈরি পোশাক খাত, নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, খাদ্য সহ নয়টি সেক্টরে দক্ষতার ঘাটতি নিয়ে একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ  করছে । অর্থনৈতিক খাতে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের বন্টন নিয়ে একটি পরিসংখ্যানে  দেখা যায়  ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত  ৩৮.৩  শতাংশ কর্মচারী কৃষি খাতে,২১.৩২  শতাংশ শিল্পে এবং ৪০.৩৮ শতাংশ সেবা খাতে সক্রিয় ছিল।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১১.২ শতাংশ যেখানে সার্বিক বেকারত্বের হার ৪.৩ শতাংশ। সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর  অধীন কলেজসমূহ বা পলিটেকনিক যেখান থেকেই উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করা হোক না কেন প্রায় এক তৃতীয়াংশ (≥৩৩%) স্নাতক শিক্ষা সমাপ্ত করার এক থেকে দুই বছর পরও পূর্ণকালীন কাজে নিয়োজিত হতে পারে না।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ঘাটতি মোকাবেলার জন্য  শিক্ষার্থীদের কর্মোপযোগী করে গড়ে তোলার চাহিদা মেটাতে পারছেনা। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিল্পের মাঝে নিবিড় যোগাযোগ ও সহযোগিতা থাকে । দক্ষতার ঘাটতি মেটাতে পদক্ষেপের অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মূলতঃ জনশক্তি তৈরি ও সরবরাহের কাজ করে। শ্রমবাজারে কী ধরনের জনশক্তি প্রয়োজন কোন কোন প্রশিক্ষণ দরকার, সেভাবে কারিকুলাম তৈরি ও  প্রয়োজনীয় উপাদান যোগ বা  পরিবর্তন করা হয়।  জ্ঞান দান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কর্মোপযোগী করে তোলা হয় ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ফিউচার অফ জবস রিপোর্টের তৃতীয় সংস্করণ অনুসারে, প্রযুক্তির গ্রহণ বৃদ্ধির সাথে সাথে ২০২৫ সালের মধ্যে সমস্ত কর্মচারীদের ৫০%কে পুনরায় দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন হবে। যেহেতু নিয়োগকর্তারা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও  সমস্যা সমাধানের দক্ষতায়   বিশ্বাস করেন।  তাই আগামী পাঁচ বছরে এর প্রয়োজনীয়তা ও বিশিষ্টতা ক্রমে ক্রমেই  বৃদ্ধি পাবে। এই বছর নতুন ভাবে উদীয়মান হল স্ব-ব্যবস্থাপনার দক্ষতা যেমন: সক্রিয় শিক্ষা, স্থিতিস্থাপকতা, চাপ সহনশীলতা এবং নমনীয়তা।

চাকরি সমীক্ষার ভবিষ্যৎ-এর উত্তরদাতারা অনুমান করেন যে প্রায় ৪০% কর্মীদের ছয় মাস বা তার কম সময়ের মধ্যে পুনর্দক্ষতা গ্রহণের  প্রয়োজন হয়ে পড়বে । মহামারীর অর্থনৈতিক প্রভাবে "দ্বৈত-ব্যঘাত" এবং "অটোমেশন ট্রান্সফর্মিং" এর কারনে চাকরি ক্ষেত্র এ ক্রমবর্ধমান দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন হচ্ছে। আমাদের কর্মক্ষম অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পরবর্তী পাঁচ বছরে পুনরায় দক্ষতা নেয়ার  প্রয়োজনে উচ্চস্তরের শিক্ষা সংক্রান্ত কৌশলগত পরিকল্পনার এখনই গতি পরিবর্তন করা দরকার।

যেহেতু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জনশক্তি সরবরাহের কাজ করছে, সুতরাং এখন থেকেই দক্ষতার ঘাটতি মেটাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জনশক্তি সরবরাহের কাজ করছে, তাদের কী ধরনের জনশক্তি প্রয়োজন, কোন কোন প্রশিক্ষণ দরকার, তা জানিয়ে দিলে তাদের পক্ষে কারিকুলামে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে । এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আরো কর্মোপযোগী করে তোলা যাবে।

বাংলাদেশের  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষাদানের পরও তার শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের কথা ভাবতে হবে। এজন্য তাদের যেসব প্রয়োজনীয় দক্ষতা দরকার, সে গুলোর চর্চা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে  সেন্টার গঠন করে সেখানে গ্র্যাজুয়েটদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের উল্লিখিত ১০টি গ্র্যাজুয়েট স্কিলস  যাতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আয়ত্ত করতে পারেন সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বক্তৃতা সহ   বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন ও এতে  শিক্ষার্থীদের অংশ গ্রহন নিশ্চিত করতে হবে এতে তাদের নিজেদের অজান্তেই এসব গ্র্যাজুয়েট নানাহ স্কিল আয়ত্ত করতে পারবেন । তাদের দৈহিক সুস্থতা ও মানসিক বিকাশ ঘটবে। আর  এজন্য একটা দুর্নীতিমুক্ত, সংবেদনশীল এবং শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দরকার।

লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা’র, সেন্ট পলস কলেজ, জার্মানির ইউনিভার্সিটি অৰ এডুকেশন, এবং স্পেন এর ইউনিভার্সিটি অৰ ভিগো’র সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, প্রাবন্ধিক, মুক্তিযোদ্ধা, রেড ডিয়ার, (আলবার্টা) কানাডা নিবাসী।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030069351196289