সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হয় এই সংগঠন। এই সংগঠনটি বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ও শিক্ষকদের দাবিদাওয়া আদায় করা মূলত এই সংগঠনের কাজ। বিভিন্ন পেশাজীবীদের ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন রয়েছে। নিজ নিজ সংগঠন নিজেদের পেশাগত উন্নয়ন এবং তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করে। পাশাপাশি তাদের বিপক্ষে কোনো অন্যায় আচরণ করা হলেও সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। পেশাগত সংগঠনের এমন ভূমিকার পাশাপাশি আরো কতগুলো কাজ করা উচিত। কেননা তারা দেশের ও রাষ্ট্রের মেধাবী জনগোষ্ঠী।তাদের কাছে অন্যদের প্রত্যাশা অনেক। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে এ প্রত্যাশা আরো বেশি। কেননা তাঁরা নিজেরা মেধাবী এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁদের বসবাস। মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তা-চেতনার লালনক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। কেননা বাংলাদেশের সব সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বৈরাচার পতন আন্দোলন—সবই সূত্রপাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নব্বই-পরবর্তী আন্দোলনেও শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বিভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষকদের সচেতনতা ও আন্দোলনকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এখন বড় কোনো আন্দোলনের দরকার না হলেও দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ওপর আঘাত হানা হলেও সামাজিক অসংগতি এবং অব্যবস্থাপনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের সজাগ থাকা এবং কঠোর প্রতিবাদ করার দাবি রাখে, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় শিক্ষকদের মধ্যে আগের মতো সচেতনতা এবং প্রতিবাদ করার মনোভাবে যেন চিড় ধরেছে। ভাটা পড়েছে তাঁদের মধ্যে প্রতিবাদের আগ্রহ। তাঁদের মধ্যকার বিভেদ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। আগে যেমন তাত্ক্ষণিকভাবে প্রতিবাদের ঝড় উঠত, এখন ধীরে চলো নীতি। ভেবেচিন্তে কাজ কে কী মনে করে তা নিয়ে ভাবনা।
কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতি করার সুযোগ আছে। আইন তাঁকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে। অন্যদের তা নেই, কিন্তু স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাঁর রয়েছে। সেই সুযোগের ব্যবহার করা আমাদের দরকার। কখনো কখনো সাধারণ মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, আমরা কোন ইস্যুতে কী বলি, কিন্তু আমরা অনেক সময় কিছুই বলি না মানে চুপ করে থাকি কিংবা নিজেকে গুটিয়ে রাখি। আবার অনেক সময় নগ্নভাবে লেজুড়ভিত্তিক মনোভাব নিয়ে এমনভাবে বলি যেন সাধারণের কাছে তার কোনো মূল্য পায় না। ফলে আমার কথা ও কাজ দিয়ে আমার কিংবা আমাদের উপকার হচ্ছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসছে না। কেউ কোনো চাপ অনুভব করছে না। আমাদের ইতিহাস বিকৃত করা হয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক করা হয়, সমাজে অনেক অন্যায় ও অবিচার প্রতিনিয়ত পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু আমরা সোচ্চার নই। মনে রাখতে হবে আমাদের প্রথম কাজ শিক্ষা ও গবেষণা। তবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় আচরণ হলে, রাষ্ট্র যে মূল নীতিতে দাঁড়িয়ে আছে তাকে ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপ করা হলে একজন পেশাজীবী হিসেবে প্রতিবাদ করা আমার প্রধান কাজ। আমি যদি তা না করি, তাহলে অন্যরা অনুসরণ করার পথ খুঁজে পাবে না। আমাদের অতীতেও ছিল, এখনো অনেক অনুকরণীয় শিক্ষক আছেন। আমরা সবে হারালাম আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক হাসান আজিজুল হককে। তাঁরা তাঁদের লেখনী ও রাস্তায় প্রতিবাদের মাধ্যমে আমাদের শিখিয়ে গেছেন কিভাবে প্রতিবাদ করতে হয়। তাঁদের আদর্শ হিসেবে নিয়ে পথ চলতে হবে।
শিক্ষকদের নিজেদের উন্নয়ন ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে দায় অনেক এবং করণীয়ও বেশি। আর এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রথমে আসি নিজেদের দাবিদাওয়ার প্রসঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলা, নিয়োগ, পদোন্নতি ও শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ফেডারেশনের কাজ অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যখন গ্রেড ১ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরা ফেডারেশনের কঠোর ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। কঠোর আন্দোলন না হলে হয়তো আমরা বঞ্চিত হতাম, কিন্তু আমরা গত কয়েক বছর নিজেদের ও রাষ্ট্রের জন্য কোনো ভূমিকা পালন আমাদের চোখে পড়ছে না। অন্য অনেক পেশাজীবী তাঁদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে এক, কিন্তু আমরা যেন নীরব। সমাজ এমন এক জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যেখানে কঠোর ও জোরালো দাবি না করলে কোনো কিছু পাওয়া যায় না। উন্নত কর্মপরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে না পারলে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা সহজ হবে না। সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া একজন আমলা কিংবা ব্যাংকার জানেন কোন পর্যায়ে তাঁর কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কাজেই শুরু থেকেই চাকরি তাঁকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার মতো তেমন কিছু নেই। এখানেই কাজ করতে হবে শিক্ষক ফেডারেশনের। তাদের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
আমরা মনে করি, জাতির সামনে দেশের সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা অনেক। পাশাপাশি যেকোনো অন্যায় ও অবিচার দেখলে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কাজটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। কেননা তাঁরা জাতির বিবেক। আমাদের কাছ থেকে জাতির প্রত্যাশা অনেক। বিষয়টি একাডেমিকভাবেও আমরা দেখতে পারি। সভা ও সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারি। যেখানে প্রথিতযশা শিক্ষকদের এনে তাঁদের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি ও জানাতে পারি। সব মত ও পথের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি ও আদর্শের যারা বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে এই রাষ্ট্র আমার, আপনার, সবার। এর বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নেয় তারা কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। কোনোভাবে আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের দিকে তাকালে চলবে না। আমাদের সমষ্টির স্বার্থ ও রাষ্ট্রের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের কাছে মনে হয় এ ক্ষেত্রে শিক্ষক ফেডারেশনের অনেক করণীয় রয়েছে। প্রতিবছর অন্তত একবার আমরা আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের কাছে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন ও মিশন সম্পর্কে অবহিত করতে পারি। আমরা কী করতে চাই, তাও বলতে পারি। কিভাবে শিক্ষার গুণগত মান সব স্তরে বাড়ানো যায় তার জন্য পরামর্শ দিতে পারি এবং তাদের পরামর্শও গ্রহণ করতে পারি। পাশাপাশি আমাদের কোনো দাবিদাওয়া থাকলে তাও পেশ করতে পারি। আমরা চাই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : ড. নিয়াজ আহম্মেদ, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়