বিশ্ববিদ্যালয়ে উপেক্ষিত মাতৃভাষা

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: যে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত। যে দেশে মায়ের ভাষা রক্ষায় এত ত্যাগ, সে দেশেই পিছিয়ে পড়ছে বাংলা ভাষা। উচ্চশিক্ষায় দিন দিন বাংলার চর্চা কমছে। কার্যত উচ্চশিক্ষায় বড় সংকটে রয়েছে মাতৃভাষা। বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইংরেজিতে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার চর্চা নেই বললেই চলে। সেখানে পরীক্ষাও বাংলায় দেওয়ার সুযোগ নেই। পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোটামুটিভাবে বাংলার ব্যবহার থাকলেও নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলার চর্চা কম। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগই প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশে  ৫৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১১৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৮টিই মেডিকেল, কৃষি, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়ের বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যাল। যেগুলোর বেশিরভাগেই বাংলা পড়ানো হয় না। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়  বাংলাকে গুরুত্ব দেয় না। ১১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র সাতটির নাম বাংলায়। বাকি ১০৮টির নাম ইংরেজিতে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকেই বাংলা পড়াতে চায় না। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাত্র ১৮টিতে বাংলা বিভাগ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থী না পাওয়ায় অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ চলছে নামকাওয়াস্তে। নতুন করে কেউ বাংলা বিভাগ খোলার আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

সূত্র জানায়, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউজিসির পূর্ণ কমিশনের সিদ্ধান্তে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশের অভু্যুদয়ের ইতিহাস’ এবং ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ নামের দুটি বিষয় যোগ করা হয়। ইউজিসির অনুরোধে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনা করেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পাদনা করেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমপক্ষে দুই ক্রেডিটে এ বিষয় দুটি যাতে পড়ানো হয়, সে ব্যাপারে নির্দেশনাও জারি করে ইউজিসি। নির্দেশনার সাত বছর পার হলেও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় তা মানছে না।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোর্স পরিচালনা করে তারা। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ অনুযায়ী। এ আইনে ভাষাবিষয়ক কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই ইউজিসি অনুরোধের বাইরে কিছু করতে পারে না। কিন্তু সেই অনুরোধে কান দেয় না বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরাই শিক্ষকদের বলে দেন, সব ইংরেজিতে হতে হবে। কেউ বাংলা ব্যবহার করবেন না। তাহলে বাংলার প্রসার কীভাবে হবে?’

শিক্ষার্থীরা বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগের পুরনো কিছু বিষয়ে বাংলায় আকর পাঠ্য বই পাওয়া যায়। তাদের পরীক্ষায় ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও লেখার সুযোগ রয়েছে। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের পুরোপুরিই ইংরেজি বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবই করতে হয় ইংরেজিতে। এতে ইংরেজিভীতির কারণে অনেকেই ধার করা অ্যাসাইনমেন্ট বা গবেষণাপত্রে সামান্য পরিবর্তন করে নিজের বলে চালিয়ে দেয়। ফলে বাংলাদেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষাপীঠে অধ্যয়ন করলেও স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যেই গবেষণা সীমিত।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটি, গণবিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়, সিসিএন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি এবং রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু রয়েছে। তবে বাংলা বিভাগ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সাত-আটটিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে চার বছরের স্নাতক (সম্মান) কোর্স রয়েছে। প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ থাকলেও বাংলা বিভাগ নেই। শিক্ষকরাও ইংরেজিতে ক্লাসে পাঠদান করেন। ইদানীং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোরও বেশিরভাগ ক্লাস নেওয়া হয় ইংরেজিতে। ফলে উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থীরা বাংলাবিমুখ হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘মাতৃভাষায় যেভাবে শিক্ষাগ্রহণ করা সম্ভব, অন্য কোনো ভাষায় তা সম্ভব নয়। আমরা যদি চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের কথা বিবেচনা করি, তারা কিন্তু তাদের নিজেদের ভাষায়তেই পড়ছে এবং উন্নতি করছে। আমেরিকান বা ব্রিটিশরা ইংরেজিতে পড়ছে বলে আমাদেরও পড়তে হবে তা কিন্তু নয়।’

তিনি বলেন, ‘সমস্যা হলো, আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে সেভাবে সমৃদ্ধ করতে পারিনি। বাংলায় ভালো অনুবাদ নেই, সাহিত্যও খুব বেশি নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আকর পাঠ্য বই বাংলা ভাষায় নেই বললেই চলে। তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কী করবে? আমাদের এখন আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করার কাজ বেশি করে করতে হবে। উচ্চশিক্ষায় বাংলার চর্চা বাড়াতে হবে। ইংরেজি ভাষাকেও রাখতে হবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, ‘ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশ তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি তেমন ব্যবহার করে না। তারা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে লালন করে বলেই উন্নত দেশ হতে পেরেছে। তারা ভালো বই পেলে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে নেয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সে চর্চা নেই। আমি বলব, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইংরেজি পড়াক, তবে বাংলার চর্চাও সমানতালে থাকতে হবে। আর এই চর্চাটার দায়িত্ব ইউজিসিকে নিতে হবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস - dainik shiksha যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক - dainik shiksha মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি - dainik shiksha এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক - dainik shiksha ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের নতুন পদক্ষেপ - dainik shiksha শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের নতুন পদক্ষেপ প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025389194488525