বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধিদীপ্ত পর্যালোচনা প্রয়োজন

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

জগন্নাথ হল ম্যাগাজিনে ঢাকা ভ্রমণরত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ছাপা হয় ১৯৩২ সালে। তাতে তিনি লিখেছিলেন :‘দিনের পথিক মনে রেখ আমি চলেছিলেম রাতে, সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখনো এক দশক অতিক্রান্ত করেনি। হিন্দু ও মুসলমান অভিজাত শ্রেণির দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পাথেয় করে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ নতুন দিনের দিকে যাত্রা করে। ররীন্দ্রনাথের ‘বাসন্তিকা’ নামের এই কবিতা তাই সাংকেতিক অর্থে সমৃদ্ধ। জাতীয় জীবনে পুরাতনের পৌরহিত্যের দিন শেষ। তবে নতুন দিনের নেতৃত্বকে ভুলে গেলে চলবে না, অন্ধকার রাতের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন যারা। সোমবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ইত্তেফাক প্রত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে বিশেষভাবে স্মরণীয় এর প্রতিষ্ঠালগ্নের প্রধান মানুষেরা। নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ও ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্যদের উদ্যোগে ও সহায়তায় এই জনপদের মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ হার্টগ কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্থপতি ছিলেন না, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্চশিক্ষার প্রসারে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য; পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তার প্রস্তাবেই গড়ে ওঠে লন্ডনের স্কুল অব অরিয়েন্টাল আর্টস (ল্যাম্বো, ২০১৭)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ বছরের মূল্যায়নে তাই শুরুর দিনগুলোর আশাবাদ ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ২০২১-এর বাস্তবতার তুলনা এসেই যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা ও উদ্দেশ্য ধ্রুব নয়। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিকল্প প্লেটোর একাডেমি ও তার শিষ্য অ্যারিস্টটলের পেরিপ্যাটোর মধ্যে কালের পার্থক্য কয়েক দশকের এবং শিক্ষা পদ্ধতিকে পাঠভিত্তিক থেকে নিরীক্ষাভিত্তিক করে তোলেন অ্যারিস্টটল (প্যান্ডারসন, ১৯৯৭)। পশ্চিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশের সময় থেকে আজকে পর্যন্ত যত দিন অতিবাহিত হয়েছে, তা মানবসভ্যতার তুলনায় সামান্য। এই সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত ধারণা ও প্রয়োগে বিবিধ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়নে যেসব মানদণ্ড ব্যবহূত হচ্ছে, সেসবও স্থায়ী বা অপরিহার্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ি দিয়েছে ঔপনিবেশিক, পরাধীন ও স্বাধীন—এই তিন রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায়।

এর বাইরে বিশ্ব জুড়ে বিগত অর্ধশতকে রাষ্ট্র, সমাজ ও বিশ্বিবদ্যালয়ের আন্তঃসম্পর্কও পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন এতটাই প্রভাববিস্তারি ও জটিল যে শতবর্ষে একটি প্রতিষ্ঠানের সরল মূল্যায়ন এখন আর সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বেও গত অর্ধশতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা, উদ্দেশ্য ও মূল্যায়নের মানদণ্ড নিয়ে যথেষ্ট ওলটপালট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেন্ড বা গতিধারা বুঝতে আমরা যুক্তরাজ্যের দুটি রিপোর্টের একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে নিতে পারি (তবে এর অর্থ এমন নয় যে আমরা ঔপনিবেশিক চিন্তাকাঠামোর মধ্যেই ঘুরপাক খেতে চাইছি; বরং ঐ চিন্তাকাঠামোর ক্রিটিক আমাদের মতো দেশগুলোর সরকারি নীতি গঠনে জরুরি)। প্রথম প্রতিবেদনটি রবিনস রিপোর্ট নামে খ্যাত। লর্ড রবিন্সের সভাপতিত্বে উচ্চশিক্ষা কমিটির এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ লর্ড লিওনেল রবিন্স লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ছিলেন। দ্বিতীয়টি ২০১০-এ প্রকাশিত দ্য ব্রাউন রিভিউ। যুক্তরাজ্যের সরকার নিয়োজিত উচ্চশিক্ষার তহবিল এবং শিক্ষার্থী অর্থায়নবিষয়ক এই ‘স্বতন্ত্র পর্যালোচনা’র প্রধান ছিলেন ব্যবসায়ী লর্ড ফিলিপ ব্রাউন, যিনি ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বা ভূমিকা নিয়ে লিওনেল রবিন্সের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো :উচ্চশিক্ষা কেবল অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতামূলক নাগরিক তৈরির কারখানা নয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌল উদ্দেশ্যও এটা হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত মূল্য অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো সূচক দ্বারা পরিমাপযোগ্য বা সংখ্যায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়নে জরুরি এর রূপান্তর করার ক্ষমতাকে যাচাই করা। একজন শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তিক রূপান্তরের সামর্থ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের পরিমাপক (রবার্ট ২০১০)।

সহজেই অনুমেয়, ব্রাউনের প্রতিবেদন এই অবস্থান থেকে যথেষ্ট দূরে অবস্থান করবে। এর সারাংশ হচ্ছে :উচ্চতর ডিগ্রির মাধ্যমে ডিগ্রি অর্জনকারীর উচ্চতর আজীবন উপার্জন নিশ্চিত হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। কোনো রাখঢাক না রেখেই সেখানে বলা হয়—যে ডিগ্রি থেকে বেশি আয় হয়, সেই ডিগ্রিতে খরচও বেশি করতে হবে। এবং আয়রোজগার ঠিকমতো নিশ্চিত করতে পারবে না যেসব ডিগ্রি, সেগুলো হারিয়ে যাবে। রবিন্স ও ব্রাউনের রিপোর্টদ্বয়ের দ্বন্দ্বের চরিত্র ইডিওলজিক্যাল বা মতাদর্শিক। এই দ্বন্দ্বের বিচার বর্তমান প্রবন্ধে সম্ভব নয়। তবে আমরা এটিকে মোটা দাগে ব্যক্তি ও সমাজকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ও বাজারকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বৈপরীত্য দিয়ে বুঝে নিতে পারি। এ কথা মনে রাখতে হবে, বাজারকেন্দ্রিক শিক্ষা পরিকল্পনা নিশ্ছিদ্র নয়। উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার এবং শিক্ষা ঋণ নিয়ে আজীবন দেনার দায়ে জর্জরিত কোটি কোটি শিক্ষার্থীর প্রসঙ্গগুলো উন্নত বিশ্ব উত্তপ্ত রাজনৈতক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে, প্রভাব রাখছে সরকার গঠন ও পতনে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দশকের অর্থনৈতিক সূচকে উন্নতির কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের অধিকাংশই তৃতীয় বিশ্বের রুগ্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেটেছে। এই বাস্তবতায় পৃথিবীর অনেক দেশেই, বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়, অর্থ, অস্ত্র এবং ঋণদাতা শক্তিশালী দেশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ‘পরামর্শে’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কর্মী সরবরাহের কারখানায় রূপান্তরের চেষ্টা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা, প্রাতিষ্ঠানিক আলস্য ও দক্ষতার অভাবের কারণে বাজারকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষার মডেল বাস্তবায়িত হতে পারেনি। এবং ঠিক এই কারণগুলোর জন্যই সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও গুরুত্ব হারাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একাধিক বৈশ্বিক মন্দা ও অতিমারির প্রভাব ঐ মাত্রায় পড়েনি, যে মাত্রায় দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে পড়েছে এবং সেখানকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থনৈতিক হতাশাকে পুঁজি করে চরম ডানপন্থি রাজনীতির উত্থান ঘটেছে এবং তাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। উদাহরণ হিসেবে ব্রাজিলের কথা বলা যায়। ১৯৩৪ সালে স্থাপিত সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয় ব্রাজিলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পড়ে। উদার সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক মানসিকতা সৃষ্টিতে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এরকম আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পরিণত হলেও কেন্দ্রীয় সরকার সেগুলোকে দুর্বল করে রেখেছে। বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির ফসল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট দুই দশকে বাড়েনি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্বতা রক্ষায় এই তিনটি বিষয়েই সচেতন থাকতে হবে। উল্লেখ্য, বাণিজ্যিকীকরণের বিতর্কটি ক্যান্টিনের খাবারের মূল্য, ভর্তি ফি বৃদ্ধি কিংবা নৈশ কোর্সের মতো কয়েকটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজস্ব অর্থায়নের সামর্থ্যই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হতে পারে। বাণিজ্যিকীকরণের প্রধান প্রভাব জ্ঞানতাত্ত্বিক। সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস জ্ঞানের এই আপাত অলাভজনক শাখাগুলোকে রুগ্ণদশার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সাহিত্যতাত্ত্বিক টেরি ইগলটনের মন্তব্য অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ—আমরা আমাদের সময়ে যা দেখেছি, তা হলো সমালোচনার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৃত্যু। মার্গারেট থ্যাচারের পর থেকে [১৯৯০], উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রগুলো স্থিতিশীলতা বজায় রেখে গেছে; ন্যায়বিচার, ঐতিহ্য, কল্পনা, মানবকল্যাণ, উন্মুক্ত ভাবনা বা ভবিষ্যতের বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির মাধ্যমে এটিকে চ্যালেঞ্জ করেনি। কেবল মানবিক বিভাগগুলোতে রাষ্ট্রীয় তহবিল বৃদ্ধির মাধ্যমে এটিকে পরিবর্তন করা যাবে না (কারণ এটা স্রেফ তহবিল একেবারে না থাকার চেয়ে ভালো)। পরিবর্তন হবে তখন, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যা কিছু হবে তার কেন্দ্রীয় বিষয় হবে মানবিক মূল্যবোধ এবং নীতির বুদ্ধিদীপ্ত পর্যালোচনা। (ইগলটন, ২০১০)


লেখক : ড. মীজানুর রহমান, সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048401355743408