বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নেতৃত্ব সময়ের দাবি

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

আমি ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। নির্বাচিত হওয়ার অল্পদিন পর সরকার কর্তৃক অযাচিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গ্রেড অবনমন করা হয়। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃত্বে অনেক আন্দোলন হয় এবং এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকায়। আন্দোলন এক সময় দানা বেঁধে ওঠে। অনেক আন্দোলন ও আলোচনার পর সরকার এক সময় শিক্ষকদের একটি দাবি মেনে নেয়। আসলে এটি নতুন কোনো দাবি ছিল না। এটি ছিল মূলত বিদ্যমান গ্রেড কেড়ে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মাসের পর মাস রাস্তায় নামিয়ে ও বিভিন্ন ধরনের অপমান করে আবার গ্রেড ফিরিয়ে দেওয়া। শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর)  এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরো জানা যায়, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে শেখ হাসিনার সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অহেতুক সর্বজনীন পেনশন স্কিমে (যার প্রতি দেশের মানুষের কোনো আকর্ষণ বা আস্থা ছিল না) যোগ করে আরেকবার ঝামেলায় ফেলে দেয়। এবার, এক মাস কর্মবিরতির পরও, কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা দূরে থাক, ওবায়দুল কাদের সাহেব বলে বসলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বুঝতে অক্ষম ছিল। চীন ফেরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী তো ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের রীতিমতো তুলোধুনো করলেন এবং আন্দোলন করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনি সবাই জানেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের আয়ু যখন প্রায় শেষ, তখন এ প্রত্যয় প্রকল্প থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেওয়া হয়। আসলে এটি শিক্ষকদের আন্দোলনের ফসল বললে ভুল হবে। ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতার ভয়েই সরকার এটি করেছিল।

২০১৫ সালের মতো ২০২৪ সালেও শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের প্রতিবাদ দূরে থাক, সামান্য মনোবেদনাও প্রকাশ করেনি। তবে বিভিন্ন ফোরাম এবারের অবমাননার জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে। আসলে ২০১৫ সালের অবনমন এবং ২০২৪ সালের প্রত্যয় স্কিমে ঢুকিয়ে দেওয়া-দুটি বিষয়ই আমলারা সরকারপ্রধানকে ভুল বুঝিয়েছেন বলে দাবি করেন একশ্রেণির শিক্ষক নেতা, যা অত্যন্ত হাস্যকর। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে তারা আমলাদের সঙ্গে শিক্ষকদের একটি অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে মানসিক সান্ত্বনা পেতেন বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি শেখ হাসিনার শ্যেন দৃষ্টিকে আড়াল করতে চাইতেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী যদি ঠিকমতো বুঝতেই না পারতেন, তাহলে এটি ছিল তার অক্ষমতা এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় নিদারুণ ব্যর্থতা। আসলে ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ছিলেন তার এর অন্যতম অসহায় শিকার।

অবশ্য তার এবং তার দলের নেতাকর্মীদের প্রতি কিছু শিক্ষকের অকল্পনীয় তোষামোদ হয়তোবা তাকে এমন ধারণা দিয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোনো আত্মসম্মানবোধ নেই এবং তাদের যা খুশি তা-ই বলা যায়। আসলে ১-২ শতাংশের বেশি শিক্ষক তোষামোদির কাজে সেভাবে জড়িতও ছিলেন না। এদেশে হয়তোবা বর্বর হত্যাকাণ্ডের হুকুমদাতা হিসাবে শেখ হাসিনার বিচার হবে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বারবার অপমানের জন্য কোনো দুঃখ প্রকাশ হয়তোবা শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কখনো করবে না। তবে যে শিক্ষক বন্ধুরা এখনো আওয়ামী লীগের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন, তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য এ বিষয়টির একটি বিহিত হওয়া প্রয়োজন।

এবারের আন্দোলনের ফসল কী, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আসলে গতানুগতিকভাবে নির্বাচিত ও অনেকটা গুরু-শিষ্য ধাঁচে গঠিত এ ফেডারেশনের কার্যকারিতা অত্যন্ত দুর্বল বলে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। উল্লেখ করতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের শীর্ষ নেতারা ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব লোকজনের জন্য পদ-পদবি বাগাতে ব্যাপক সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। আরও অভিযোগ আছে, এ ফেডারেশনের নেতারা অবলীলায় শিক্ষকদের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারেন, যা অন্য কোনো গোষ্ঠী কখনো করে না। এখন কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান ফেডারেশনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের নিজে থেকেই সরে যাওয়া উচিত। তবে ফেডারেশনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের এ ব্যাপারে ব্যাপক আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। অনেক শিক্ষকই আমার মতামতের সঙ্গে একমত হবেন বলে আশা করি। এ লেখাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের মনের ভাবের বহিঃপ্রকাশ বলেও আমি বিশ্বাস করি। তবে এ ব্যাপারে আরও আলোচনা হতে পারে এবং ভিন্নমতও আসতে পারে।

সে যাই হোক, বর্তমান সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, যারা সপ্রতিভ ও উচ্চকণ্ঠ, তারা একটি অর্থবহ জোট গড়ে তুলতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক একটি কার্যকর মোর্চা হিসাবে সাম্প্রতিক ক্রান্তিকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ নেটওয়ার্কের শিক্ষকরা বৃহত্তর সম্মিলন ঘটানোর জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মনের ভাষা পড়তে ইচ্ছুক ও সক্ষম এবং শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য একটি কার্যকর ও সমন্বিত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেতৃত্ব এখন সময়ের দাবি।

শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা কিন্তু সহজ নয়। দীর্ঘদিন ধরে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক সরকারি দলের এক ধরনের দখলদারিত্ব কায়েম ছিল। নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন প্রশাসনগুলোর প্রথম কাজ হবে হলগুলোতে মেধার ভিত্তিতে আসন বণ্টন করে কোনো প্রকার ভয়ভীতি ছাড়া শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান নিশ্চিত করা এবং অনতিবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে ও বাধাহীনভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মুক্ত ও ভয়ভীতিহীন পরিবেশ নিশ্চিত করা। এসব কঠিন কিন্তু অতীব প্রয়োজনীয় কাজগুলোতে গ্রহণযোগ্য ও সাহসী শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে উপরের কাজগুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে হয়।

বিভিন্ন ক্যাম্পাসে এখনো এক ধরনের ভয়ের আবহ বিরাজ করছে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসকে নিরাপদ মনে করছে না। নতুন প্রশাসনগুলোকে এ ভয়ের বাতাবরণ ভেঙে ছাত্র আন্দোলনের প্রকৃত ফসল উপহার দিতে হবে। নতুন প্রশাসনগুলোকে উপরোক্ত কাজগুলো করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। একটি বৃহত্তর, অর্থবহ, কার্যকর ও সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোর্চা এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক: ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী, অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মাদরাসা শিক্ষকরাও অষ্টম গ্রেড পাবেন - dainik shiksha মাদরাসা শিক্ষকরাও অষ্টম গ্রেড পাবেন নেড়ি কুকুরের ভাষণে শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি নিয়োগ বিত্তান্ত - dainik shiksha নেড়ি কুকুরের ভাষণে শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি নিয়োগ বিত্তান্ত বাংলাদেশের পাঠ্যবই ভারতে ছাপাতেই হবে কেনো? - dainik shiksha বাংলাদেশের পাঠ্যবই ভারতে ছাপাতেই হবে কেনো? অধ্যক্ষ জুবাইদা রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হচ্ছেন! - dainik shiksha অধ্যক্ষ জুবাইদা রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হচ্ছেন! ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার : সেনাবাহিনী যা যা করতে পারবে - dainik shiksha ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার : সেনাবাহিনী যা যা করতে পারবে তিন ক্যাটাগরির গুণী শিক্ষক বাছাইয়ে নাম পাঠানোর আহ্বান - dainik shiksha তিন ক্যাটাগরির গুণী শিক্ষক বাছাইয়ে নাম পাঠানোর আহ্বান মাদকের গডফাদারদের ধরার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার - dainik shiksha মাদকের গডফাদারদের ধরার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার শিক্ষা প্রশাসনে বদলি আতঙ্কে নাহিদ-দীপু সিন্ডিকেটের ৯২ কর্মকর্তা - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বদলি আতঙ্কে নাহিদ-দীপু সিন্ডিকেটের ৯২ কর্মকর্তা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031337738037109