বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাপদ্ধতি ও ফি জটিলতা

বিপ্লব বড়ুয়া |

সরকার তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ইতেমধ্যে দেশে অনেক সাফল্য দেখিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন সফলতার পরও দেশের হাতেগোনা চার থেকে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় অভিন্ন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণ করাকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কেউ ভালো চোখে দেখছেন না। দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করা অনেকে  দুরভিসন্ধি-অবহেলা মনে করেছেন। পরীক্ষাপদ্ধতিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার যে অপচয় হয়, এই অপচয় রোধে আর কতো বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমরা জানি, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বব্যাপী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে সময়োপযোগী কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। অন্যান্য দেশের শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে আমাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতিতে বিস্তর ফারাক। পরিচালনা পদ্ধতিতে আছে বড় ধরনের গাফিলতি। আছে ভর্তি ফি, সেশন ফি, সেমিস্টার ফি নেয়ার ক্ষেত্রে হযবরল অবস্থা।

সরকার মাধ্যমিক ও কলেজ শাখায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বেসরকারি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজ করছে চরম বিশৃঙ্খলা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবার মানসিকতার পরিবর্তে ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি বাড়াতে দিলে অদূর ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। একজন শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বিভিন্ন মেডিক্যাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার আবেদন করতে গিয়েই অনেকটা ঝরে পড়ে। তার কারণ, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে হারে ভর্তির আবেদন ফি ধার্য করা হয়, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বহু অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পারছে না।

এইচএসসি শেষ করে শিক্ষার্থীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় উচ্চশিক্ষা লাভে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তির। বাংলাদেশে এই ভর্তিযুদ্ধ জটিল প্রকৃতির। তার ওপর আছে আসন সংকট। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে অনেক অভিভাবক অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন আবেদন ফরমের ফি জমা দিতে । বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো আলাদা আলাদাভাবে বড় অঙ্কের ফি নিয়ে থাকে। পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক না কেনো, আমি মনে করি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক অধিকার। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে দূরে থাকতে হয়। তাই সংগত কারণে ভর্তি পরীক্ষা ফি-মুক্ত করা দরকার। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে আসা-যাওয়া, থাকাতেই যেখানে হাজার হাজার টাকা অপচয় করতে হয়, সেখানে অতিরিক্ত ভর্তি ফি একজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের জন্য একটি বিশাল বোঝা নয় কি?  মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং লেভেলে পড়ার ক্ষেত্রে যোগ্যত্য থাকা সত্ত্বেও অসচ্ছল দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত ফি পরিশোধের কারণে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি থেকে ছিটকে পড়ছে।

দেশের সনামধন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেকের পড়ার ইচ্ছা থাকে কিন্তু অর্থনৈতিক দীনতায় তারা সে আশা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ জাতীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু সরকার নিয়ন্ত্রণ করে, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গুচ্ছতে রূপান্তর করে সব শিক্ষার্থীকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া। সেই সঙ্গে ভর্তির আবেদন ফি তুলে নেয়া, নয়তো একটি সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করা। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃপক্ষ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেশ কয়েক বছর ধরে একটি গুচ্ছতে একত্রীকরণ করে পরীক্ষা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমি অবস্থার কারণে তা কার্যকর করতে পারেনি। যেখানে ডিজিটাল পদ্ধতির সহায়তায় অনেক কঠিন কাজকে সহজ করে দিচ্ছে, সেখানে এ দুরবস্থা থেকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা উত্তরণ চায়। দেশে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা একসঙ্গে হতে পারলে এই গুটি কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা হতে বাধা কোথায়? বর্তমানে দেশে মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত সংখ্যা ১১২টি। এ ছাড়া তিনটি আছে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে মেডিক্যাল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করার ফলে অল্প খরচে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা যোগ্যতার ভিত্তিতে যে যেখানে পড়ার সুবিধা পাচ্ছে। এ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একেক ইউনিটে ভর্তি ফরম পূরণ আবেদনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা ফি ধার্য করা হয়েছে, এটি শুধু অযৌক্তিক নয়, অনৈতিকও।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই অবগত আছেন, শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করে নিতে একজন শিক্ষার্থীকে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ করতে হয়। পছন্দের বিষয় ও প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেতে একজন শিক্ষার্থীকে কম করে হলেও ৮ থেকে ১০টি প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি, কক্সবাজার-টেকনাফ কিংবা পঞ্চগড়-তেতুলিয়া থেকে একজন ছেলে বা মেয়ে শিক্ষার্থী ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে হলে কতো টাকা রাস্তায় ফেলে দিতে হয়। এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যদি একজন করে অভিভাবক থাকে, তাহলে কী পরিমাণ খরচ পড়ে। যদি একেকটি পরীক্ষায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে ৮/১০টি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে খরচ গুনতে হয় ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা। প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষা ঘনিয়ে এলে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা এক ঘোর অমানিশায় দিন কাটায়। ভর্তি পরীক্ষা সহজীকরণ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় শোরগোল পড়ে যায়। কোনোরকমে পরীক্ষাটা নিয়ে ফেলতে পারলে আলোচনাও শেষ, জোর তদবিরও শেষ হয়ে যায়। আলোচনার বিষয় থেকে আবার পুরো একটি বছর নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। এভাবে বছরের পর বছর আর কত শিক্ষার্থী তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, কেউ কি বলতে পারেন? বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকদের উদ্দেশে বলতে চাই, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের এই অভিযোগটি আমলে নেয়ার কি কোনোরকম সুযোগ নেই?  

এ বছর আমার সন্তান উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আগামী বছর আপনার সন্তান কিংবা কাছের দূরের অনেক নিকট আত্মীয়ের সন্তানও অর্থনৈতিক কারণে ভর্তি পরীক্ষা দেয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আশু এই বিষয়ে যদি একটি সমাধানে আসে, তাহলে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়া থেকে ঘুরে দাঁড়াবে। আর দেরি না করে সরকার, শিক্ষামন্ত্রণালয় ও ইউজিসির উচিত এই বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণে কঠোর হওয়া। যেকোনো উপায়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শিথিল, সেমিস্টার ফি, ভর্তি ফিতে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিলে শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে বলে অনেকের ধারণা এবং দেশের শিক্ষাপদ্ধতিতে নতুন গতি ফিরে পাবে বলে দৃঢ় প্রত্যাশা।        

লেখক: বিপ্লব বড়ুয়া, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! এবারও ভারতে ছাপা হবে ১ কোটি পাঠ্যবই - dainik shiksha এবারও ভারতে ছাপা হবে ১ কোটি পাঠ্যবই ইউজিসিতে দুইজন নতুন সদস্য - dainik shiksha ইউজিসিতে দুইজন নতুন সদস্য বুয়েটের নতুন ভিসি অধ্যাপক বদরুজ্জামান - dainik shiksha বুয়েটের নতুন ভিসি অধ্যাপক বদরুজ্জামান উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি ওবায়দুল ইসলাম - dainik shiksha উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি ওবায়দুল ইসলাম ৬ষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি হতে না দেয়ার হুঁশিয়ারি বদলি প্রত্যাশীদের - dainik shiksha ৬ষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি হতে না দেয়ার হুঁশিয়ারি বদলি প্রত্যাশীদের নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যা যা করতে হবে - dainik shiksha ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যা যা করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন ডিজি আব্দুল হাকিম - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন ডিজি আব্দুল হাকিম কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.011229991912842