বিশ্বায়নের যুগে র্যাঙ্কিং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্ববিদ্যলয়কে পরিচিত করে তোলে। এই র্যাঙ্কিং শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি মুল্যবান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পদ্ধতিগত মূল্যায়ন। যেমন-উচ্চশিক্ষার গুণগত মান, গবেষণা আউটপুট এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসহ বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে র্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানের শক্তি ও দুর্বলতাগুলোকে দৃশ্যমান করে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু বলেছিলেন, ‘দেশ ভালো হয় যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’
ইউজিসির পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশে বর্তমানে ৫৩টি পাবলিক, ৩টি আন্তর্জাতিক ও ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার সাধারণ, প্রকৌশল, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মেডিক্যাল, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে সংযুক্ত বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। এদের মধ্যে শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়, কয়েকটি আছে অর্ধশতবর্ষী। এগুলোর মধ্যে কোনোটির অবস্থা কেমন, পড়াশুনার মান কী ইত্যাদি জানা প্রয়োজন। তাই প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিং, সেটি হতে পারে দেশের অভ্যন্তরে। হতে পারে দক্ষিণ এশিয়া কিংবা পুরো এশিয়া এমনকি গোটা পৃথিবীতে।
লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন ৫টি মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে। যেমন-শিক্ষা, গবেষণা, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম অর্থাৎ শিল্পের সঙ্গে গবেষণা কর্মের বাণিজ্যিকীকরণ। টাইম হায়ার এডুকেশনের নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান যাচাই করা হয় দুটি বিষয় লক্ষ্য করে। শিক্ষার মান ও গবেষণার মান। ৩০ শতাংশ প্রতিমান থাকে শিক্ষার মানে, ৩০ শতাংশ থাকে গবেষণার অর্থ, সংখ্যা ও মানে, ৩০ শতাংশ থাকে গবেষণার প্রভাবে, ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থাকে বিদেশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিদেশে গবেষণায় আর ২ দশমিক ৫ শতাংশ থাকে দেশের গবেষণা অনুদান নিয়ে। বিশ্ববিখ্যাত কোয়াককুয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিংয়ে ৯টি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়।
স্পেনের মাদ্রিদভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্স র্যাঙ্কিং প্রাধান্য দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটের কনটেন্ট, শীর্ষ গবেষক এবং সেরা গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশনের ওপর।
এ বছরের জানুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১১ হাজার ৩৯৪টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিং-২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম সংস্করণের প্রতিবেদন। প্রথম হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণ পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রভাব, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ভূমিকা বিবেচনা করে স্পেনের মাদ্রিদভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্স। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে আসছে। প্রতি বছর জানুয়ারি ও জুলাই মাসে তারা এটি প্রকাশ করে।
এসব রেটিং একটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায়, প্রথম দশ-বারটি ছাড়া বাকিগুলোর রেটিংয়ের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যাকে ৭০০ বলা হচ্ছে , অন্য রেটিংয়ে সেটি হচ্ছে ১৫০০-এর পরে। আজ যে ২০০০ তমের মধ্যে স্থান পায়নি, পরের মাসে বা মাস দুয়েক পরে দেখা যায় সেটিই প্রথম। এ কি এক জগাখিচুড়ি কাণ্ড! কিসের ভিত্তিতে এ রকম ব্যবধান এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলো কিন্তু শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কাছেই স্পষ্ট নয় যা স্পষ্ট করা উচিত। ফলে এতসব র্যাঙ্কিং-এর আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, কেউ ভালোভাবে কিছু বুঝতে পারছে না। সাধারণ মানুষেরও কিন্তু একটি রেটিং আছে। তারাও বোঝেন যে, বুয়েটের পড়াশুনা বাংলাদেশের অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত, তারা প্রায় স্বীকার করবেন, নর্থ সাউথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইউল্যাব অনেক এগিয়ে আছে। তারা সবাই জানেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষক সংখ্যা অনেক বেশি, এখানে ভর্তি হলে শিক্ষার্থীরা এমনিতই অনেক কিছু জানেন পরিবেশের কারণে। তবে রাজনীতির আখড়া এবং বর্তমানকালের শিক্ষার্থীরা এই রাজনীতি করে কোনো ধরনের সুনাম কুড়াতে পারছে না, দুর্নাম ছাড়া।
এই রেটিং দিয়ে কি হয় বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এতে কিছু যায় আসে? বিশাল উন্মুক্ত ক্যাম্পাস, নামমাত্র বেতন, বিশাল হল, লাইব্রেরি, শিক্ষকরা ক্লাস নেন আর না নেন, শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করুক আর না করুক, ছাত্র সংগঠনগুলো এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ক্যাম্পাসে থাকতে দিক আর না দিক, শিক্ষকরা পড়াশোনা না করিয়ে পার্টির গুণগান করুক আর ভিসি সরাসরি সরকারি পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করুক আর নাই করুক মেধাবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সেগুলোতে ভর্তি হতে হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি নিজেদের মান বজায় রাখার নিমিত্তে ও কোয়ালিটির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ না করার জন্য নিজেদের অস্তিত্ব নিজেরাই ঘোষণা করছে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করার একটি বিষয় আছে। কারণ, মালিকরা এতো মূলধন খাটিয়ে যদি লাভ না পান তাহলে কীভাবে চালাবেন? এসবের ওপর ভিত্তি করে কেউ কেউ র্যাঙ্কিংয়ের পেছনে ছুটছেন। মান রক্ষা করার চেষ্টায় নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতে পড়ে যায় বিপদে। কারণ, কম টিউশন ফিতে শিক্ষার্থী ভর্তিতে এগিয়ে থাকে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তারা র্যাঙ্কিং স্থান করে নেয়ার মাধ্যমে আন্তার্জাতিক শিক্ষার্থী আকর্ষণ করতে ব্যর্থ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই র্যাঙ্কিয়ের পেছনে অর্থ ব্যয় না করে যদি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যয় করতো তাহলে ভালো হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি ধরি তাহলে বিসিএস ক্যাডার উৎপাদনে এগিয়ে। এখন এটি কোনো র্যাঙ্কিংয়ের মান? এ ছাড়াও যদি ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মারামারি কথায় আসি তাহলেও র্যাঙ্কিংয়ে এটি এগিয়ে থাকবে! কাগুজে গবেষণায় যদি আসি যা দেশ ও জাতির সরাসরি খুব একটা কাজে লাগেনা সেটি তো নামমাত্র যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই করেন প্রমোশনের জন্য। যদি শিক্ষা ক্যাডার বা শিক্ষা প্রশাসনের দিকে তাকাই তাহলে হয়তো দেখা যাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকবে। প্রতিপক্ষ শিক্ষার্থীকে দ্রুত হল ও ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার দৌড়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ই পারদর্শী তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইদানিং এই র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকবে। রাজশাহীও এই র্যাঙ্কিংয়ে আগ্রগামী। বাকীগুলোর মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতাও নেই।
ইউজিসি ও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল মিলে একটি স্টান্ডার্ড তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়েরগুলোর অবজেকটিভ র্যাঙ্কিং করার প্রয়োজন ছিলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য, একটি টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এবং অন্যটি জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। আমাদের ইউজিসি একবার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করে চেষ্টা করেছিলো প্রকৃত অবস্থা জানার। বিভিন্ন ক্যাটাগরি করে কোন ক্যাটাগরির কি কি দূর্বলতা ও সবলতা তা প্রকাশ করেছিলো। কিন্তু নর্থসাউথসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলোকেই র্যাঙ্কিং বলে পত্রিকা ও টিভিতে প্রচার শুরু করে দিয়েছিলো বেশি শিক্ষার্থী পাবার আশায়। পরে অবশ্য তারা থেমেছিলো নানা কারণে। আবার নতুন করে ইউজিসি আগ্রহ প্রকাশ করছে র্যাঙ্কিং করার। আগে বিশ্ববিদ্যালয়েরগুলোর গবেষণার মান নির্ধারণ করতো গুটিকয়েক জার্নাল দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জার্নালের সংখ্যা বেড়েছে। এসব জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ ছাপাতে অপেক্ষা করতে হয়, অর্থের ব্যাপার আছে। আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই যথাযথ বা মানসম্মত পিএইচডি প্রোগ্রাম চালাচ্ছে না বা তাদের মূল বিষয় পিএইচডি পড়ানো নয় সেখানে গবেষণায় আমাদের দেশে খুব বেশি পয়েন্ট পাবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো এ ধরনের প্রোগ্রামের এখনো অনুমোদন নেই।
মৌলিক ও গুণগত মানসম্পন্ন প্রকাশনার সংখ্যা এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের যথাযথ সাইটেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। গবেষণা যতো সমসাময়িক ও মৌলিক হবে, প্রকাশনা ততো ভালো হবে এবং সাইটেশন ততো বেশি হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ গবেষণা পিয়ার রিভিউবিহীন দুর্বল প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত হয়, যেগুলো গুণগত মানের জার্নালে সাইটেশন হয় না বললেই চলে। ফলে এসব গবেষণালব্ধ প্রকাশনা দ্বারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে সাইটেশন অংশে স্কোর অর্জনে পিছিয়ে থাকে। শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির একটি নিয়ামক।
অনেকেই বলছেন র্যাঙ্কিং উন্নত বিশ্বের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো থেকে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা চালানোর একটি পদ্ধতি। এগুলোর অধিকাংশেরই মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বাণিজ্যিক। তারা র্যাঙ্কিয়ের মাধ্যমে উপার্জন করে। একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম কিউ এস র্যাঙ্কিংয়ের বার্ষিক আয় ৭৫ মিলিয়ন ডলার। আর টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলার। র্যাঙ্কিংয়ের যেসব মানদণ্ড তা সব ওয়েবসাইটে থাকে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর, সরেজমিনে কোনো প্রদর্শন বা ডাটা কালেকশন বা ইন্টারভিউ হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে র্যাঙ্কিং কীভাবে হয়? শুধু ওয়েবসাইটের ওপর ভিত্তি করে এবং পরিচিত শিক্ষকদের মতামতের ওপর র্যাঙ্কিং নির্ভর করছে এটি আমাদের প্রকৃত অর্থে কোনো বার্তা দিচ্ছে না।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক