বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সুদেষ্ণা সিংহ বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ভাষাশহীদ। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা’র মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছেন তিনি। বিশ্বের প্রথম নারী ভাষাশহীদ হলেন কমলা ভট্টাচার্য। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে আসামে যে ১১ জন প্রাণ দিয়েছিলেন, তিনি তাদেরই একজন।

‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বসবাসকারী এক প্রান্তিক জাতির নাম। ব্রিটিশ শাসনামলের প্রাক্কালে ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের পর মণিপুর থেকে এরা উত্তর-পূর্ব ভারত, মিয়ানমার ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। সেই মণিপুরীদেরই একটি অংশ এই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। এ ছাড়া রয়েছে মৈতেয় মণিপুরী, পাঙন মণিপুরী। বর্তমানে ভারতের আসাম রাজ্যভুক্ত হাইলাকান্দি, কাছাড়, পাথারকান্দি, করিমগঞ্জ, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মণিপুর রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী

সম্প্রদায়ের অধিকাংশের বসবাস। বাংলাদেশে মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলাতেও তাদের বসতি চোখে পড়ে। ভারতের মণিপুরসহ আসামের বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, এমনকি বাংলাদেশেও ‘কে মণিপুরী আর কে নয়’—তা নিয়ে একটি আন্তঃজাতিগত দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। মণিপুরের সিংহভাগ আদিবাসী মৈতেয়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে এবং বাংলা-অহমিয়ার সঙ্গে মিল থাকায় বিষ্ণুপ্রিয়াদের ভাষাকে ‘মণিপুরী ভাষা’ হিসেবে অনেক মৈতেয় স্বীকৃতি দিতে নারাজ। অন্যদিকে ভারতের জাতীয় নথিপত্রগুলোয় দুই জনগোষ্ঠীকেই ‘মণিপুরী’ হিসেবে দেখানো হলেও ‘মণিপুরী’ ভাষা হিসেবে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সব ভাষাভাষীর প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু আসামে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের এই অধিকার দীর্ঘদিন ধরে না থাকায় তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ ক্ষোভ থেকেই ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আসামের বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ওই বছর ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা’ মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সাত দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, পরে যা ‘সত্যাগ্রহে’ রূপ নেয়। দশকের পর দশক ধরে এ আন্দোলন ব্যাপক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর রবিশংকর সিংহ, কুলচন্দ্র সিংহ প্রমুখের নেতৃত্বে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৯২ থেকে ’৯৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আসাম ও ত্রিপুরায় বেশ কয়েকবার রাজপথ ও রেলপথ অবরোধ, গণঅনশন, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। অনশন কর্মসূচি ২৪ থেকে শুরু করে ৪৮ এমনকি ১০১ ঘণ্টাব্যাপী পালিত হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত জনতার সংগ্রামে টনক নড়ে সরকারের। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মে প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপুরী মণিপুরী ভাষা চালু করে ত্রিপুরা সরকার। আসামে এ দাবি তখনো গৃহীত হয়নি, তাই মার্চ মাসে গণসংগ্রাম পরিষদ লাগাতার রেল অবরোধের কর্মসূচির ডাক দেয়। এসব কর্মসূচি পালনের ফলে বরাক উপত্যকা অচল হয়ে পড়ে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এই বরাক উপত্যকাতেই একদিন আসে এক গগনবিদারী রক্তক্ষয়ী দিন! ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ। দিনটি ছিল শনিবার। লোঙাই ঘাটের দক্ষিণপাড়ে কচুবাড়ি গ্রাম। দলে দলে জয়োধ্বনি করতে করতে কচুবাড়িবাসীরা ‘ইমার ঠার’-এর আন্দোলনে যোগ দিতে লাগল।

বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় ‘ইমার ঠারের’ অর্থ ‘মায়ের ভাষা’। দলে দলে বিষ্ণুপ্রিয়াভাষী মানুষ জড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলনে। নিজ ভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় রেল অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিতে অন্য সবার মতো সুদেষ্ণাও মার্চের (বাংলা চৈত্র মাস) এক কাঠফাটা দিনে বিদায় নেন মায়ের কাছ থেকে। তিনি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের কাছে কিছু টাকার আবদার করেছিলেন। কিন্তু দুঃখিনী মায়ের কাছে একটি কানাকড়িও ছিল না। সুদেষ্ণার সঙ্গে ছিল তার বান্ধবী প্রমোদিনী, বিলবাড়ি গ্রামের এক তরুণী। প্রমোদিনীর কাছেই দুটি টাকা চেয়ে নেয় সুদেষ্ণা। সকৌতুকে প্রমোদিনী তার বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করে, ‘কীসের জন্য এ দুটো টাকা? কলকলি ঘাটের এ পথে তো কোনো দোকানপাটও নেই!’ সুদেষ্ণা নীরব। প্রমোদিনী দুটো টাকা বেঁধে দেয় সুদেষ্ণার আঁচলে। মিষ্টি হাসিতে সুদেষ্ণা তখন বলেছিল, ‘এ দুটো টাকা খেয়াপারের জন্য (মৃত্যুর পর খেয়া পারাপারের মাধ্যমে অন্য জগতে পদার্পণ করতে হয় বলে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরীদের বিশ্বাস)।’ প্রাণপ্রিয় বান্ধবী প্রমোদিনীর কাছে সুদেষ্ণার দ্বিধাহীন শেষ কণ্ঠবাণী, ‘মোর রকতলো অইলেউ মি আজি ইমার ঠারহান আনতৌগাগো চেইস (দেখিস, আমার রক্ত দিয়ে হলেও আজকে আমি আমার মাতৃভাষাকে কেড়ে আনব)।’

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ থেকে ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ দীর্ঘ ৫০১ ঘণ্টার রেল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ সময় রাজপথে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা আসামের কলকলি ঘাটের গুংঘাঝারি রেলস্টেশনে করিমগঞ্জ (আসাম, বাংলাদেশের সীমান্তে) থেকে আসতে থাকা একটি ডাউন ট্রেন অবরোধ করে। আন্দোলন চলাকালে কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়াই পুলিশ অবরোধকারীদের ওপর গুলি চালায়। সেদিন পুলিশের গুলিতে ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় আহত হন শতাধিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সুদেষ্ণা সিংহ।

পরে হাসপাতালে নিহত হন আরেকজন বিপ্লবী তরুণ সলিল সিংহ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাম ও ত্রিপুরাজুড়ে গণআন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। এসবের জেরে পরবর্তীকালে সব দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় আসাম সরকার। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি আসামে বরাক উপত্যকার প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (১৫২টি) বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় পাঠপঠনের ব্যবস্থা চালু করা হয়। এর ছয় বছর পর ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশে বিষ্ণুপ্রিয়া ‘মণিপুরী’ ভাষা হিসেবে তার মর্যাদা ফিরে পায়। বিষ্ণুপ্রিয়ারা শহীদ সুদেষ্ণাকে সম্মান জানিয়ে বলে ‘ইমা সুদেষ্ণা’; ‘ইমা’ শব্দের অর্থ মা। নিজেদের ভাষাকেও তারা ‘ইমার ঠার’ অর্থাৎ ‘মায়ের ভাষা’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ভারতের আসাম প্রদেশের কাছাড় জেলার শিলচরে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার চাইতে গিয়ে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের ১৯ তারিখ যে ১১ জন বীরশহীদ আত্মাহুতি দেন তাদের মধ্যে ছিলেন প্রথম নারী ভাষাশহীদ মাত্র ১৭ বছরের তরুণী কমলা ভট্টাচার্য। ওই ঘটনার ৩৫ বছর পর ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে শহীদ হন ৩১ বছর বয়সী সুদেষ্ণা সিংহ। সুদেষ্ণাকেই আদিবাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম ভাষাশহীদ গণ্য করা হয়। বিশ্বে এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, এ দুজন নারীই ভাষার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন। সুদেষ্ণা সিংহ নিজের মৃত্যুর মাধ্যমে একটি ভাষাকে তার মৃত্যুদশা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তাই পৃথিবীর ভাষার ইতিহাসে এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জাতির ইতিহাসে এই ১৬ মার্চ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাংলাদেশের পূর্বে এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা কখনোই সুদেষ্ণা ও তার আত্মত্যাগের কথা ভুলতে পারে না। আসাম সরকারের পাশাপাশি ত্রিপুরা সরকারও এ দিনটিকে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত উভয়প্রান্তের বিষ্ণুপুরী মণিপুরীভাষী মানুষ প্রতিবছর রক্তঝরা এই ১৬ মার্চকে স্বভাষার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ‘শহীদ সুদেষ্ণা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।

সুদেষ্ণার জন্ম ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি আসামের বরাক উপত্যকার নিচে সুরমা উপত্যকার কচুবাড়ি গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। গ্রামবাসী আদর করে তার ডাকনাম দেয় ‘বুলু’। পরিবারের সহায়-সম্বলহীন সামর্থ্যকেই চিরসঙ্গী করে নিয়ে তার ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিশ্বের সব ভাষাশহীদ এবং ভাষাসংগ্রামীকে সালাম জানাই। কেননা ফেব্রুয়ারির ‘২১’, মে খ্রিষ্টাব্দের ‘১৯’ আর মার্চের ‘১৬’ সংখ্যা তিনটি পৃথক হলেও অন্তরে এ তিনটি সংখ্যার একই বোধ ক্রিয়াশীল, ইতিহাসজুড়েই রয়েছে মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ!

লেখক: জাকির হোসেন, সহকারি সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

সূত্র: দৈনিক কালবেলা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! এবারও ভারতে ছাপা হবে ১ কোটি পাঠ্যবই - dainik shiksha এবারও ভারতে ছাপা হবে ১ কোটি পাঠ্যবই ইউজিসিতে দুইজন নতুন সদস্য - dainik shiksha ইউজিসিতে দুইজন নতুন সদস্য বুয়েটের নতুন ভিসি অধ্যাপক বদরুজ্জামান - dainik shiksha বুয়েটের নতুন ভিসি অধ্যাপক বদরুজ্জামান উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি ওবায়দুল ইসলাম - dainik shiksha উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি ওবায়দুল ইসলাম ৬ষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি হতে না দেয়ার হুঁশিয়ারি বদলি প্রত্যাশীদের - dainik shiksha ৬ষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি হতে না দেয়ার হুঁশিয়ারি বদলি প্রত্যাশীদের নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যা যা করতে হবে - dainik shiksha ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যা যা করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন ডিজি আব্দুল হাকিম - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন ডিজি আব্দুল হাকিম কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045468807220459