টানা বৃষ্টির দাপটে রাজধানীর সড়কে জলজটসহ ভোগান্তিও খানিকটা বেড়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টি থামার সম্ভাবনা নেই। হয়তো কোনোদিন খুব বেশি বৃষ্টিপাত হবে, আবার কোনোদিন কম। এ অবস্থায় আজ শুক্রবার বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হবে। এতে বৃষ্টির প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
আবহাওয়াবিদ শাহিনুল ইসলাম জানান, শুক্রবারও রাজধানীতে তীব্র বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এটি ক্রমাগত চলতেই থাকবে। তবে ১৫ অক্টোবরের পর বৃষ্টির প্রবণতা কমে যাবে। এর কারণ সম্পর্কে মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তাকেই দায়ী করেছেন তিনি।
এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পাঁচ বিভাগে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অতিবৃষ্টির ফলে পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কাও রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার আবহাওয়া অফিসের এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত রাজধানীতে ৪৪ মি.মি. বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এদিন সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রামে ১২০ মিলিমিটার (মিমি)।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় ভারি (৪৪-৮৮ মিমি) বৃষ্টি হতে পারে। তবে অতিভারি বৃষ্টি হলে একদিনে ২৮৯ মিমি পর্যন্ত বৃষ্টি ঝরতে পারে।
আবহাওয়াবিদরা জানান, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা অবশ্য মনে করেন, আগামী ৪ ও ৫ অক্টোবর বৃষ্টির প্রবণতা বেশ কমে আসবে। কোথাও কোথাও রোদেরও দেখা পাওয়া যাবে। তবে সেটি সাময়িক। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী দেশের ১৭টি অঞ্চলে ঘণ্টায় ৪৫-৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে ঝোড়ো হাওয়াসহ বজ্রবৃষ্টি পারে।
আগামী ৭২ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটির বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়ার মডেল অনুযায়ী অক্টোবর মাসকে ঘূর্ণিঝড়প্রবণ মাসও বলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৫৯টি ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছে। যার মধ্যে আটটি দেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে। বাকিগুলো মিয়ানমার ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আছড়ে পড়ে। ১৮৯১-২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ৪৩টি। যার অধিকাংশই বাংলাদেশে আঘাত করেছে।
শুধু এ মাসে ১-৩টি নি¤œচাপ তৈরি হতে পারে। যার মধ্যে অন্তত একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক জানান, সাগরে এক মাসে অন্তত তিনটি নি¤œচাপ তৈরি হলে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। আমাদের দীর্ঘদিনের তথ্য ও অনুসন্ধান এই নির্দেশনায় দেয়। সে অনুযায়ী এই মাসে একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরির প্রবল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। তবে এটি বাংলাদেশের মাটিতে আঘাত করবে কি না তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে ১৬টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে। এই সময় অতিতীব্র ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যাও ১৬টি। তবে যদি অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই তিন মাসের ঝড়ের হিসাব করা যায় তবে এ সংখ্যা আরও বেশি। ১৯৭১-২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই তিন মাসে ৩৮টি ঘূর্ণিঝড় ও ৬৮টি অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় সাগরে তৈরি হয়েছে। এসব ঝড়ের কারণে দেশের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বাড়ছে।
শুধু ঝড় নয়, অক্টোবরে তাপমাত্রা ও বৃষ্টির হিসাবেও পরিবর্তন এসেছে। যা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হিসেবে বর্ণনা করছেন। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, অক্টোবর মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের হার ১৬০ দশমিক ৩ মিমি। এবার মাসে ৭-৮ দিনের বেশি বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে গড় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের হারের চেয়ে বৃষ্টিপাত বেশি হতে পারে। এ ছাড়া অক্টোবর মাসের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবং দিন যত যাবে ততই তাপমাত্রা কমতে থাকবে।
এই আবহাওয়াবিদ মনে করেন, এই মাসের শেষের দিকে প্রান্তিক পর্যায় অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে শীতের অনুভূতি পাওয়া যাবে। আবহাওয়ার ভাষায় সেটিকে শীত বলা না গেলেও প্রকৃত শীতের আগমনী বার্তা আসবে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে। আবহাওয়াবিদরা জানান, চলতি মাসে ৩০-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা উঠানামা করবে। তবে দিনের ও তাপের তাপমাত্রা বেশি থাকবে।
এদিকে মঙ্গলবার বঙ্গোপসাগরে তিনটি লঘুচাপ সৃষ্টি এবং এর মধ্যে একটি নি¤œচাপ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দিতে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি এই পূর্বাভাস দিয়েছে।
মাসব্যাপী পূর্বাভাসে আরও বলা হয়েছে, মাসের প্রথমার্ধে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু (বর্ষা) বাংলাদেশ থেকে পর্যায়ক্রমে বিদায় নিতে পারে। দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে দু-চারদিন মাঝারি থেকে তীব্র বজ্রঝড় এবং সারাদেশে তিন-পাঁচদিন হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বজ্রঝড় হতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে পারে; তবে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা কিছুটা বেশি থাকবে।