বিশিষ্ট কবি ও সমাজনেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল এর জন্মদিন আজ। তিনি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে বরিশালের শায়েস্তাবাদে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ আবদুল বারি পেশায় ছিলেন উকিল। সুফিয়ার যখন সাত বছর বয়স তখন তার পিতা গৃহত্যাগ করেন। নিরুদ্দেশ পিতার অনুপস্থিতিতে তিনি মা সৈয়দা সাবেরা খাতুনের স্নেহ-পরিচর্যায় লালিত-পালিত হতে থাকেন।
যে সময়ে মুসলিম মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষায় ছিলো একেবারেই পশ্চাৎপদ, সে সময়ে সুফিয়া কামালের মতো স্বশিক্ষিত ও সমাজপ্রগতি-সচেতন নারীর আবির্ভাব ছিলো এক অসাধারণ ব্যাপার। শায়েস্তাবাদে নানার বাড়ির রক্ষণশীল অভিজাত পরিবেশে বড় হলেও সুফিয়া কামালের মনোগঠনে দেশ, দেশের মানুষ ও সমাজ এবং ভাষা ও সংস্কৃতি মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। বাড়িতে উর্দুভাষার চল থাকলেও নিজ উদ্যেগেই তিনি বাংলা ভাষা শিখে নেন।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়া মায়ের সঙ্গে কলকাতা যান। সেখানে তার সাক্ষাৎ হয় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর সঙ্গে। কিছুদিন পরে তিনি শায়েস্তাবাদ ফিরে আসেন বটে, কিন্তু তার শিশুমনে রোকেয়া-দর্শনের সেই স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকে; রোকেয়ার ব্যক্তিত্ব তাকে অবিরাম অনুপ্রাণিত করতে থাকে।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে হয়। পরে তিনি ‘সুফিয়া এন হোসেন’ নামে পরিচিত হন। সৈয়দ নেহাল হোসেন সুফিয়াকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দেন। সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। ফলে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন তার প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’, যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সুফিয়ার সাক্ষাৎ হয়। এরপূর্বে গান্ধীর স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি কিছুদিন চরকায় সুতা কাটেন। তিনি এ সময় নারীকল্যাণমূলক সংগঠন ‘মাতৃমঙ্গল’-এ যোগ দেন।
সুফিয়া তার স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় গেলে সেখানে বিশেষ বিশেষ বাঙালি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তাদের একজন হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সুফিয়ার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন এবং সেগুলো পত্রিকায় প্রকাশের জন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করেন। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ প্রকাশ করেন।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়া কামাল বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত মুসলিম মহিলা সংগঠন ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’-এ যোগ দেন। এখানে নারীশিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারসহ নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। বেগম রোকেয়ার সামাজিক আদর্শ সুফিয়াকে আজীবন প্রভাবিত করেছে। তিনি রোকেয়ার ওপর অনেক কবিতা রচনা করেন এবং তার নামে মৃত্তিকার ঘ্রাণ শীর্ষক একটি সঙ্কলন উৎসর্গ করেন। তিনি ‘রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ গঠনে সহায়তা করেন, যার প্রস্তাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হল ‘রোকেয়া’ তার নামে করা হয়।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়া মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ‘ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন’-এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তার স্বামী মারা যান। ১৯৩৩-৪১ পর্যন্ত তিনি কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এই স্কুলেই তার পরিচয় হয় প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির এবং কবি জসীমউদ্দীন এর সঙ্গে।
স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপশি সুফিয়ার সাহিত্যচর্চাও চলতে থাকে। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থটি। এর ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এর মাধ্যমেই সুফিয়ার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পরের বছর আপনজন ও শুভানুধ্যায়ীদের ইচ্ছায় তিনি চট্টগ্রামের লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পুনরায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। সেই থেকে তিনি ‘সুফিয়া কামাল’ নামে পরিচিত হন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধে, তখন দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যের ক্ষেত্রে সুফিয়া সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ এ একটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলার ব্যাপারে সাহায্য করেন। পরের বছর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশ করলে তিনি তার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরেরই অক্টোবর মাসে তিনি সপরিবারে ঢাকা চলে আসেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়া ব্যাপকভাবে সমাজসেবা ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটিতে যোগ দেন। এবছরই তাকে সভানেত্রী করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ গঠিত হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তার যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সুলতানা পত্রিকা, যার নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নগ্রন্থের প্রধান চরিত্রের নামানুসারে।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনে সুফিয়া কামাল সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর দমননীতির অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি তার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ (বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ) গঠিত হলে তিনি তার প্রতিষ্ঠাতাপ্রধান নির্বাচিত হন এবং আজীবন তিনি এর সঙ্গে জড়িত থাকেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন এবং ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন। সুফিয়া, তার স্বামী ও ছেলে দেশের মধ্যেই থেকে যান মুক্তিবাহিনীকে সাহস ও শক্তি জোগানোর জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খবরাখবর সরবরাহের জন্য। যুদ্ধকালীন তিনি একাত্তরের ডায়েরি নামে একটি দিনলিপি রচনা করেন এবং এ সময়ে লেখা তার কবিতাগুলো পরবর্তীকালে ‘মোর যাদুদের সমাধি ’পরে নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলিতে তিনি বাঙালিদের ওপর পাকবাহিনীর নৃশংসতা বর্ণনা করেন এবং দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেন। এ সময় রচিত ‘বেণীবিন্যাস সময় তো আর নেই’ কবিতায় মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি মহিলাদেরও আহ্বান জানান।
স্বাধীনতার পরেও সুফিয়া কামাল অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। তিনি যেসব সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন সেগুলি: বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি এবং দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা। এছাড়াও তিনি ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারী কল্যাণ সংস্থার সভানেত্রী ছিলেন।
সুফিয়া কামাল একালে আমাদের কাল নামে একটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন। তাতে তার ছোটবেলার কথা এবং রোকেয়া-প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। তিনি অনেক ছোটগল্প এবং ক্ষুদ্র উপন্যাসও রচনা করেছেন। কেয়ার কাঁটা তার একটি উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। তার আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: মায়া কাজল, মন ও জীবন, উদাত্ত পৃথিবী, অভিযাত্রিক ইত্যাদি। তার কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রুশ ভাষায় তার সাঁঝের মায়া গ্রন্থটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও তার বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি তার কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে Mother of Pearls and Other Poems এবং ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়া কামালের রচনা সমগ্র প্রকাশ করেছে।
সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ নামক জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন; কিন্তু ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, মুক্তধারা পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, Women’s Federation for World Peace Crest, বেগম রোকেয়া পদক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ইত্যাদি। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের Lenin Centenary Jubilee Medal এবং Czechoslovakia Medal সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও লাভ করেন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ নভেম্বর ঢাকায় তার জীবনাবসান ঘটে।