বেতন ও বিবেকের স্বাধীনতায় পিছিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষকরা

মিথিলা মুক্তা ও সাবিহা সুমি, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

শিক্ষক যদি হয় জাতির বিবেক তাহলে বাংলাদেশে সেই বিবেক নিদারুণ বেহাল দশায় নিপতিত। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাতে গোণা কয়েকজন শিক্ষককে মাঝেমধ্যে বিবেক হিসেবে সরব হতে দেখা গেলেও মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের বিবেক মূলত চাকরির ভয়েই অবদমিত। যদিও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বেতনের বিচারে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থান একেবারেই তলানিতে। কিন্তু, স্বল্প বেতনেও ওই চাকরি টেকাতেই মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হয়। জাতির বিবেক আর হয়ে ওঠা হয় না। 

গত কয়েক বছরে কয়েক দফা বেতন বাড়ানো হলেও এখনো বৈশ্বিক মানদণ্ডে পিছিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের প্রস্তাব করা হলেও, তা বাস্তবায়নে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সূত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রাথমিক  বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম। এদেশের প্রাথমিকের শিক্ষকদের গড় বেতন দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের চেয়েও কম।

ফিনল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরবসহ ইত্যাদি দেশের শিক্ষকরা বাংলাদেশি টাকার হিসাবে গড়ে আট লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা মাসিক বেতন পান। প্রতিবেশী দেশ ভারতের শিক্ষকরাও বাংলাদেশের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি বেতন পান। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক ও এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন যেখানে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায় শুরু, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা থেকে।

বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রারম্ভিক মাসিক বেতন-ভাতা প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৩৫ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ২৭ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৩ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৬৩ হাজার টাকা।

মাধ্যমিকে বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন-ভাতা ১৭ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৪০ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩২ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৯ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৯০ হাজার টাকা।

মাধ্যমিক শিক্ষার প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত। তাদেরকে সরকার সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডের সমপরিমাণ মূল বেতন দেয়। সেখানে তাদের ১৬ হাজার টাকা স্কেলে বেতন শুরু হয়। এর বাইরে তারা বাড়িভাড়া বাবদ মাসে এক হাজার টাকা ও চিকিৎসা ভাতা বাবদ মাসে ৫০০ টাকা পান। সেই হিসাবে শুরুতে একজন শিক্ষক সরকারি ভাতা ১৭ হাজার ৫০০ টাকা পান। এর বাইরে যেসব স্কুলের আয় আছে, তারা ফান্ড থেকেও কিছু টাকা শিক্ষকদের দেয়। তবে সব স্কুল তা দিতে পারে না। 

এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ। তবে স্কুলের কর্মচারীরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া তারা সরকারি কর্মচারীদের মতো বৈশাখী ভাতা পান। তবে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যারা সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে যোগ দেন, তারা শুরুতেই দশম গ্রেডে ২৬ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তারা সন্তানদের পড়ালেখার জন্য ভাতা পান। পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতাসহ নানা ধরনের সুবিধা পান। তবে সরকারি বা এমপিওভুক্ত উভয় ধরনের স্কুলেই শিক্ষকরা উচ্চতর গ্রেড বিএড সম্পন্ন হলে আলাদা ইনক্রিমেন্ট পান, তাদের বেতনও কিছুটা বাড়ে। কিন্তু সারা দেশে প্রায় ৩২ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৭০০-র কাছাকাছি। 

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা পান। স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডের বেতন স্কেলে মূল বেতন ১১ হাজার টাকা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা ও টিফিন ভাতা মিলিয়ে শুরুতে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পান। সারা দেশে এই সহকারী শিক্ষকদের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। এর বাইরে তারা নিয়মানুযায়ী সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা পান।

ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউর তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে লুক্সেমবার্গ। ইউরোপের এ দেশটির প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৫ হাজার ৯৮৪ ডলার ৩০ সেন্ট। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি। দেশটির প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৫ হাজার ৭৯৯ ডলার ৯১ সেন্ট। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা সুইজারল্যান্ডের শিক্ষকরা ন্যূনতম ৫ হাজার ৭৯ ডলার বেতন পেয়ে থাকেন।

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দেশটির সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের গড় বেতন ৪ হাজার ২০৩ ডলার ২৫ সেন্ট। দেশটির ন্যাশনাল সেন্টার অন এডুকেশন অ্যান্ড দ্য ইকোনমির তথ্য অনুযায়ী শিক্ষকদের পাঁচ ধরনের বেতন কাঠামো রয়েছে, যেখানে মাসে ন্যূনতম বেতন ২ হাজার ৩৫৩ ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরবে শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতন দেয়া হয় ৪ হাজার ১৬১ দশমিক ৮৩ ডলার। এছাড়া এশিয়ায় শীর্ষ আটে থাকা অন্য দেশগুলো হলো ওমান, কুয়েত, চীন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান এ মহাদেশের ৪৯টি দেশের মধ্যে ৪৫তম। বাংলাদেশের চেয়ে যে চারটি দেশ পিছিয়ে সেগুলোর সবই যুদ্ধবিধ্বস্ত। এর মধ্যে লেবাননে একসময় শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হতো এবং শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকেও বেশ এগিয়ে ছিল। বর্তমানে দেশটিতে শিক্ষকদের গড় বেতন নেমে এসেছে মাত্র ১৯ ডলার ২৩ সেন্টে। এছাড়া লাওসে শিক্ষকদের গড়বেতন ১৪৩ ডলার ১৪ সেন্ট, ইয়েমেনে ৭৮ ডলার ৭৪ সেন্ট ও উজবেকিস্তানে ৭৮ ডলার ৭৪ সেন্ট। 

এ ছাড়া বাংলাদেশের উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরা শুরুতে নবম গ্রেডে ২২ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পান। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা এই বেতন স্কেলের বাইরে খুব একটা সুবিধা না পেলেও সরকারি কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাড়িভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসাসহ আরো নানা সুবিধা পান।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলো প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। সবচেয়ে বেশি মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়া হয় প্রাথমিকে। তাদের বেতন-ভাতাও অন্যান্য শিক্ষকদের চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশে যেহেতু শিক্ষকদের বেতন যেহেতু কম, তাই তারা অন্য কিছু করার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশায় ঢুকলেই তারা প্রাইভেট-কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এখানে আয় বেশি হওয়ায় স্কুলের চেয়ে তারা প্রাইভেটেই বেশি মনোযোগী হন। সরকার বারবার প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ করার চেষ্টা করলেও এতে সফল হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার উন্নয়নে সবার আগে শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানোর দাবি উঠেছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি তাদের বেতন-ভাতাও সম্মানজনক হতে হবে। এজন্য যতো দ্রুত সম্ভব বেতন কাঠামোর সংশোধন আনা প্রয়োজন। নয়তো মেধাবীরা আগামীতে শিক্ষকতায় আসবেন না। 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল   SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024979114532471