বেরোবিতে অধ্যাপক নিয়োগে অনিয়ম: প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ ইউজিসি

দৈনিক শিক্ষাডটকম, বেরোবি |

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মণ্ডল আসাদকে লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ায় এ বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। একই সঙ্গে এ বিষয়ে কমিশনকে জানানোর অনুরোধ করেছে। ইউজিসির বাজেট পরীক্ষক দল বেরোবির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেট পরীক্ষাকালে আসাদ মণ্ডলের নিয়োগের এ অনিয়ম চিহ্নিত করে এ ব্যাপারে নেয়ার নির্দেশ দেয়।

গত ২৯-৩০ এপ্রিল সরজমিন পরীক্ষাকালে এই অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে লোকপ্রশাসন বিভাগের এই নিয়োগের বিষয়ে পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে সম্প্রতি একটি পরিপত্র জারি করেছে। গতকাল পরিপত্রটি সাংবাদিকদের হাতে এসেছে। ইউজিসির অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক স্বাক্ষরিত ওই পরিপত্রের সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে এবং এর সারাংশে বলা হয়েছে- প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক আসাদুজ্জামান মণ্ডল আসাদকে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়ায় নিয়মের ব্যত্যয় ও আর্থিক ক্ষতি। বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক কমিশনকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো। 

ইউজিসির অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক রেজাউল করিম হাওলাদার বলেন, ইউজিসির বাজেট পরীক্ষক দল এই নিয়োগের অনিয়ম পেয়েছে বলেই পরিপত্রের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে। আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে মঞ্জুরি কমিশনকে অবহিত করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ অক্টোবর লোকপ্রশাসন বিভাগের শূন্য পদে দুজন সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তিতে সহযোগী অধ্যাপক পদের আবেদনের শর্তে বলা হয়- সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ¯œাতক (সম্মান) ও অন্যূন দ্বিতীয় শ্রেণির ¯œাতকোত্তর ডিগ্রিসহ পিএইচডি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চার বছরসহ কমপক্ষে সাত বছরের সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা বর্ণিত যোগ্যতাসহ এমফিল ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পাঁচ বছরসহ মোট ১০ বছরের শিক্ষকতার বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আবেদনের শেষ তারিখ ছিল ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ নভেম্বর।

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপকের দুটি শূন্য পদে চারজন প্রার্থী আবেদন করেন। যার মধ্যে তিনজনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী ওই শিক্ষকদের কেউই সহযোগী অধ্যাপকের শূন্য পদে নিয়োগের শর্ত পূরণ করেন না। তবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদের পদ আপগ্রেডেশন নীতিমালা অনুযায়ী একজনের সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদনের যোগ্যতা ছিল। অপর দুই শিক্ষকের মধ্যে মো. আসাদুজ্জামান মণ্ডল আসাদ এবং সাব্বীর আহমেদ চৌধুরীর কারোরই পিএইচডি কিংবা এমফিল ডিগ্রি না থাকায় কেউই ওই পদের জন্য যোগ্য ছিলেন না। বিভাগীয় প্রধান আসাদ মণ্ডলের সভাপতিত্বে গত ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্ল্যানিং কমিটির সভায় এই অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশ করলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি সহযোগী অধ্যাপক পদের বাছাই বোর্ডের তারিখ নির্ধারণ করেন। এসব অনিয়মের বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বোর্ড স্থগিত করতে বাধ্য হন উপাচার্য।

পরবর্তী সময়ে আবার গত বছরের ১৩ জুলাই লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগের বাছাই বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়। ওই নিয়োগ-বাছাই বোর্ডে অযোগ্য প্রার্থী মো. আসাদুজ্জামান মণ্ডল আসাদকে মাত্র আট বছর এক মাসের চাকরির অভিজ্ঞতায় সহযোগী অধ্যাপকের শূন্য পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। সুপারিশটি গত বছরের ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৯৬তম সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলে প্রার্থীর চাহিত যোগ্যতা না থাকায় বাছাই বোর্ডের সুপারিশ অনুমোদন দেয়নি সিন্ডিকেট। ওই সভার সিদ্ধান্ত-০৫ মোতাবেক সুপারিশটি ফের বাছাই বোর্ডে পাঠানো হয়।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর আইন-২০০৯ এর প্রথম সংবিধি ৫(৪) ধারায় বলা হয়েছে- কোনো বাছাই বোর্ডের সুপারিশের সঙ্গে সিন্ডিকেট একমত না হলে বিষয়টি ওই বোর্ড কর্তৃক চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো হবে এবং এ ব্যাপারে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। কিন্তু ওই আইন অমান্য করে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর পুনরায় ওই বিষয়ে বাছাই বোর্ড আহ্বান করেন। উপাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই নিয়োগ-বাছাই বোর্ডের মাধ্যমে অযোগ্য প্রার্থী মো. আসাদুজ্জামান মণ্ডল আসাদকে সহযোগী অধ্যাপকের শূন্য পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয় এবং গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ৯৮তম সিন্ডিকেট সভায় তা অনুমোদন করে ওইদিনই তড়িঘড়ি করে যোগদান করানো হয়। অভিযোগ আছে, ওই নিয়োগের জন্য সিন্ডিকেটের ৯৬তম সভায় অযোগ্য প্রার্থীকে সুপারিশের বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারী সিন্ডিকেট সদস্যদের ৯৮তম সভায় অনুপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই উপাচার্য তড়িঘড়ি করে সিন্ডিকেটের সভার আগের দিন ফের বাছাই বোর্ড আহ্বান করেন এবং পরদিন সিন্ডিকেটে অনুমোদন করেন।

এদিকে আইন ভঙ্গ করে অযোগ্য প্রার্থী হিসেবে মো. আসাদুজ্জামান মণ্ডল আসাদকে সহযোগী অধ্যাপক পদে দেয়া নিয়োগপত্রে ৯৬তম সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদনের বিষয়টিও গোপন করা হয়েছে। অযোগ্য ও জুনিয়র একজন শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক তাদের জ্যেষ্ঠতা হারিয়েছেন।

লোকপ্রশাসন বিভাগের এই অনিয়ম ও আইন ভঙ্গের মাধ্যমে নিয়োগের বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাবিউর রহমান প্রধান গত বছরের ১০ অক্টোবর ইউজিসিতে অভিযোগ করলে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। এছাড়া অভিযোগকারী তাবিউর রহমানকেও চিঠি দিয়ে যথাযথ মাধ্যমে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগ করার নির্দেশ দিয়েছিল ইউজিসি। তাবিউর রহমান প্রধান ইউজিসির নির্দেশনা মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে গত ১০ জানুয়ারি অভিযোগের সব তথ্য-উপাত্ত পাঠালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেটি ইউজিসিতে পাঠায়নি বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তথ্যগুলো না পাঠানোর কথা গত ৩০ মার্চ ইউজিসি তাবিউর রহমান প্রধানকে চিঠিতে জানিয়েছে।

এ বিষয়ে তাবিউর রহমান প্রধান গতকাল সোমবার বলেন, অনিয়ম করে এই নিয়োগের ফলে অনেক শিক্ষক জুনিয়র হয়েছেন। এ কারণে ইউজিসিতে অভিযোগ করেছিলাম। বিষয়টি আমলে নিয়ে ইউজিসি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অভিযোগ করতে বলে। আমি ওই নির্দেশনা পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সব ডকুমেন্ট পাঠালেও কর্তৃপক্ষ সেটি ইউজিসিতে পাঠায়নি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
আবেদনের যোগ্যতা নেই তবু শিক্ষক - dainik shiksha আবেদনের যোগ্যতা নেই তবু শিক্ষক শিক্ষাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে - dainik shiksha শিক্ষাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কলেজছাত্রকে তুলে নিয়ে হা*তুড়ি পেটা - dainik shiksha কলেজছাত্রকে তুলে নিয়ে হা*তুড়ি পেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএমজিএসে মাস্টার্স করার সুযোগ - dainik shiksha ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএমজিএসে মাস্টার্স করার সুযোগ সাত কলেজে চূড়ান্ত ধাপের বিষয় বরাদ্দ ৩ অক্টোবর - dainik shiksha সাত কলেজে চূড়ান্ত ধাপের বিষয় বরাদ্দ ৩ অক্টোবর প্রধান শিক্ষককে তাড়িয়ে চেয়ারে বসলো ছাত্র! - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে তাড়িয়ে চেয়ারে বসলো ছাত্র! সেন্ট যোসেফে তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি আবেদন শুরু - dainik shiksha সেন্ট যোসেফে তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি আবেদন শুরু দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036261081695557