আরিফ মাহমুদ সুমন নামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘিরে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।
মোটরসাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে তিনি নিখোঁজ হন। পরে হাসপাতালের শয্যায় গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁর সন্ধান পায় পরিবারের সদস্যরা। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) বেশ কিছু দিন থাকার পর মারা যান সুমন।
পুলিশ বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা থেকে সুমনের মৃত্যু হয়েছে।
চিকিৎসকের তথ্যের বরাতে পরিবার দাবি করছে, সুমনের মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে থাকা বিভিন্ন জিনিসও তছরুপ হয়েছে। কাজেই এটা পরিকল্পিত হত্যা। গত দুই মাসেও এ মৃত্যুর ঘটনার তদন্তের কোনো কিনারা হয়নি।
পারিবারিক সূত্র জানায়, সুমন বেসরকারি সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ থেকে অনার্স সম্পন্ন করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি নেন। একই সঙ্গে স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা করছিলেন। তাঁর বাবা আকবর আলী একই মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। তিনি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার ঢাকা পলিটেকনিক স্টাফ কোয়ার্টারে সপরিবারের থাকেন।
৯ জুন রাত সাড়ে ৯টার দিকে সুমন বাসা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন। এরপর তিনি আর ফেরেননি। মা-বাবা প্রথমে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় ছেলের খোঁজ করেন। সন্ধান না পেয়ে পরদিন সুমনের বাবা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
এর দুই দিন পর ১১ জুন সকালে সুমনের বাবার মোবাইল ফোনে একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। জানানো হয়, সুমন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। সুমনের বাবা গিয়ে হাসপাতালের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের একটি শয্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর ছেলেকে খুঁজে পান। এ সময় পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ মোড়ানো সুমন অচেতন ছিলেন।
পরিবারকে চিকিৎসকরা জানান, সুমনকে আইসিইউতে নিতে হবে। তবে হাসপাতালের আইসিইউতে শয্যা খালি না থাকায় জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে ধানমণ্ডির পপুলার হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।
পপুলার হাসপাতালের চিকিৎসকরা সুমনের পরিবারকে জানান, তাঁর মাথার উপরিভাগে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করায় মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়েছে। ওই হাসপাতালে সুমনের মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারবিষয়ক কাগজেও এই আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পরে সুমনকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ৪৪ দিন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৫ জুলাই গভীর রাতে সুমনকে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
সুমনের মা শাহীনুর আক্তার বলেন, তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হতে পরে। বাসা থেকে সুস্থ ছেলে বের হয়। দুই দিন নিখোঁজ থাকে। পরে হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় তাঁকে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ‘সুস্থ-সবল ছেলের কী হলো, কিছুই বুঝতে পারছি না। কোথা থেকে কারা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়েছে, তা-ও জানি না। ’
শাহীনুর আক্তার প্রশ্ন তোলেন, ‘যদি দুর্ঘটনায় ছেলের মৃত্যু হয়ে থাকে, তাহলে মোটরসাইকেলটি অক্ষত থাকে কিভাবে? হেলমেটেরও ক্ষতি হয়নি কেন?’
তাঁর ভাষ্য, আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক রাতে সুমনের জ্ঞান ফিরেছিল। তখন মাকে সুমন বলেছিলেন, ‘মা, আমি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটাইনি। সুস্থ হই আগে, তোমাকে সব খুলে বলব। ’ সে কথা আর বলা হয়নি সুমনের।
সুমনের পরিবারের ভাষ্য, ওই জিডির সূত্র ধরে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশ তদন্তের শুরুতে ধারণা করে, সুমনকে ছিনতাইকারীরা হত্যা করেছে। এরপর দুই ছিনতাইকারীকে আটকও করা হয়। তাদের কাছ থেকে সুমনের খোয়া যাওয়া মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোনও উদ্ধার করে পুলিশ। ফোনটির আইএমই নম্বর পরিবর্তন করা হয় এবং অন্যান্য তথ্য মুছে ফেলা হয় বলে জানতে পারে পুলিশ।
এক পর্যায়ে ওই দুই ছিনতাইকারীকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তদন্ত এখানেই থেমে যায়।
এ নিয়ে আক্ষেপ করে সুমনের বাবা আকবর আলী বলেন, ওই দুই ছিনতাইকারীর কাছ থেকে সুমনের খোয়া যাওয়া মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ এই নিয়ে তদন্ত না করে বলছে, সুমন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথাসহ পুরো শরীরে আঘাত করা হয় বলে দাবি করেন সুমনের বাবা। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে হয় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, না হয় ছিনতাইকারীরা তাকে হত্যা করেছে। সেই হত্যাকাণ্ডকে এখন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অথচ সুমনের মোটরসাইকেলটিতে কোনো দুর্ঘটনাজনিত আঘাতের চিহ্ন নেই। বরং তার মাথায় ভারী আঘাতের চিহ্ন ছিল। ’
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় করা জিডির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মনির হোসেন বলেন, এটা সড়ক দুর্ঘটনা বলেই প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। তাঁর ভাষ্য, ঘটনার দিন সুমন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পড়ে ছিলেন। পরে লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে সুমনের মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
দুর্ঘটনার ঘটনাস্থল বেগুনবাড়ী থেকে হাতিরঝিলে প্রবেশমুখের সড়ক। ওই ঘটনাস্থল হাতিরঝিল থানা পুলিশের অধীন। এ ব্যাপারে হাতিরঝিল থানার ওসি আব্দুর রশিদ বলেন, লাশ দাফনের সময় পুলিশের পক্ষ থেকে ময়নাতদন্ত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু নিহতের বাবা পুলিশের কাছে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ নেওয়ার মুচলেকা দিয়েছেন। এ কারণে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করা হয়েছে। এখন পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে যে সুমনকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের যদি এ অভিযোগ থাকে, তাহলে থানায় মামলা করতে হবে।