বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ : রিটে না মেরিটে

রুম্মান তূর্য |

আপনি কি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হতে চান? গত কয়েক বছরে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ অর্জন করেছেন? নিবন্ধন পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়েছেন? কিন্তু আপনি কি মেরিট দিয়েই শিক্ষক পদে নিয়োগ পাবেন? নাকি রিট করতে হবে? শুনতে খটকা লাগলেও এমনই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আর এ জন্য শিক্ষক পদে নিয়োগ প্রত্যাশীরা দূষছেন বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষকে। নিবন্ধন পরীক্ষায় যত কম নম্বরই থাকুক না কেন, রিট করে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে আমলা শাসিত এই সংস্থাটি । রিট মৌলিক অধিকার কিন্তু প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পাওয়াও তো মৌলিক অধিকার। এমনই প্রশ্ন ও পাল্টা প্রশ্ন নিয়োগ প্রত্যাশীদের। সাম্প্রতিক সময়ে মেধার জোরে শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ অনেকেই। দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

কিছুদিন আগে বিচারাধীন থাকার পরেও দুই হাজারের বেশি পদে শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ করেছে এনটিআরসিএ। ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রিট করে আপিল বিভাগ থেকে নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার রায় পেয়েছিলেন ২ হাজার ২০৭ জন প্রার্থী। যদিও আপিল বিভাগের রায় চ্যালেঞ্জ করে রিভিউ করেছিল এনটিআরসিএ। তবুও বিচারাধীন এসব পদে নিয়োগ সুপারিশ করা হয়েছে প্রার্থীদের। বিচারাধীন পদে নিয়োগ সুপারিশ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। এনটিআরসিএর একজন সদ্য সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ছিল নানা অভিযোগ। তবুও প্রার্থীরা নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন। এর মাধ্যমেই রিট করে শিক্ষক হওয়া শুরু হলো। [প্রার্থীরা নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ায় তাদের করা আপিল বিভাগের রায় এনটিআরসিএ মেনে নিয়েছে।] রায়ের রিভিউয়েরও প্রতিদ্বন্দ্বী করা হচ্ছে না। তাই বলা যাচ্ছে আপিল বিভাগের রায় মেনে নিয়েছে এনটিআরসিএ। কিন্তু ২ হাজার ২০৭ জন প্রার্থী যে নিয়মে নিবন্ধিত হয়ে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন, সেই নিয়মেই ১৩, ১৪ ও ১৫ তম ব্যাচে নিবন্ধিত হয়েছেন মোট সাড়ে ৪৬ হাজারের বেশি প্রার্থী। তাহলে প্রশ্ন, এনটিআরসিএ কি একই নিয়মে নিবন্ধিত সবাইকে নিয়োগ সুপারিশ করবে?

যদিও এনটিআরসিএর কর্মকর্তারা এর উত্তরে বলছেন, আপিল বিভাগের রায় ও রায়ের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় তারা এসব পদ বিচারাধীন থাকার পরেও নিয়োগ সুপারিশ করেছেন। আদালত যদি কাউকে সুপারিশের নির্দেশনা দেয় সে ক্ষেত্রে তা পালন করা হবে। সে হিসেবে আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার জন্য প্রার্থীদের রিট করতে হবে। আর আইনজীবীরা বলছেন, আপিল বিভাগের বাস্তবায়িত রায় অনুসারে প্রার্থীরা শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন। তাই একই নিয়মে নিবন্ধিত প্রার্থীরা রিট করলে একই রায় পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। ফলে তারা সবাই নিয়োগ সুপারিশ পেতে পারেন। তাই এ সাড়ে ৪৬ হাজার প্রার্থী সবাই নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার রায় পেতে পারেন। আর এনটিআরসিএর সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, বিচারাধীন অবস্থায় ২ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ করে প্রচলিত বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার ‘হাঁটু ভেঙে’ দিয়েছে এনটিআরসিএ। এভাবে চললে শিক্ষক হতে প্রার্থীদের নিবন্ধন সনদে যতই নম্বর থাকুক, রিট করা ছাড়া শিক্ষক হওয়ার কোন উপায় এক পর্যায়ে থাকবে না। কারণ, এক পর্যায়ে রিটকারীদের জন্যই শূন্যপদ পাওয়া যাবে না। সাধারণ প্রার্থীরা আবেদনের সুযোগই পাবেন না।

দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রার্থীরাও বিষয়টি অনুধাবন করছেন। তারাও দলে দলে রিট করা শুরু করছেন। ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে যারা আগে রিট করেননি, তারাও নিয়োগ সুপারিশ পেতে রিট করছেন। রিট করেছেন ১৪তম নিবন্ধন পরীক্ষা উত্তীর্ণ প্রার্থীরাও। ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রার্থীরাও নিয়োগ সুপারিশ পেতে রিট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর ১৬তম প্রার্থীদের ভাইভা শেষ হলেই ফল পেয়ে যাবেন। একই নিয়মে ১৬তম নিবন্ধনে চূড়ান্ত পদে উত্তীর্ণ প্রার্থীরাও এ সাড়ে ৪৬ হাজার প্রার্থীর সঙ্গে যুক্ত হবেন।

রিট করে শিক্ষক হওয়া শুরু:

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) গঠিত হয়। তখন এনটিআরসিএর দায়িত্ব ছিল শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য প্রত্যয়ন (সার্টিফিকেশন) করা। প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের পরীক্ষা নিয়ে সনদ দেয়া। এই সনদ মানে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা। তখন নিবন্ধন সনদধারীরাই শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে পারতেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির নেয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতেন। কিন্তু ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর এক পরিপত্রের মাধ্যমে এন্ট্রি লেভেলে শিক্ষক পদের নিয়োগের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষমতা এনটিআরসিএর হাতে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তৎকালীন শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান-এর স্বাক্ষরে জারি হওয়া সে গেজেটে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষমতা দেওয়া হয় এনটিআরসিএকে। বলা ছিল, এনটিআরসিএ শূন্যপদের বিপরীতে প্রার্থীদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করবে ও নিয়োগ সুপারিশ করবে। পরে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের উপজেলা, জেলাভিত্তিক মেধা তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ সুপারিশের ফলাফল প্রকাশ করবে। সে প্রেক্ষিতে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। তিন ধাপে তথা প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভায় অংশ নিয়ে চূড়ান্তভাবে ১৭ হাজার ২৫৪ প্রার্থী এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উত্তীর্ণদের নিয়োগ সুপারিশের আশ্বাস দেওয়া হলেও তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পরে তারা আন্দোলন শুরু করেন। এক পর্যায়ে এতেও ফল না পেয়ে ২ হাজার ২৭০ জন প্রার্থী রিট দায়ের করেন।

এদিকে, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট এনটিআরসিএ-এর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ১৬৬টি রিটের নিষ্পত্তি করে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের সাত দফা নির্দেশনা দিয়ে একটি রায় দিয়েছিল। ওই রায়ে প্রার্থীদের জাতীয় মেধাতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে নিয়োগ সুপারিশ করার নির্দেশনা ছিল। সে রায় মেনে নিয়ে বেসরকারি শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ করছে এনটিআরসিএ। সে অনুসারে মেধাবি প্রার্থীরাই নিয়োগ সুপারিশ পাচ্ছেন। ফলে, ১ থেকে ১২তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণরাও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। আর ১৩তমদের একক নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে, তারা সবার সাথেই জাতীয় মেধাতালিকার ভিত্তিতে আবেদন করতে পারতেন।

দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগ ১৩তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণ ২ হাজার ২৭০ প্রার্থীর সেই রিটের রায় দেন। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদের দ্বৈত বেঞ্চ ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনধারীদের গেজেট ও পরিপত্র অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশনা দেন। এনটিআরসিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান আশফাক হুসেন সে রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেন। রায় চেম্বারকোর্টে স্টে করা হলে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় (হাইকোর্টের সাত দফা নির্দেশনা অনুসারে)। কিন্তু পরে চেম্বারকোর্ট থেকে স্টে অর্ডার উঠিয়ে দেয়া হয়। এনটিআরসিএ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। কয়েক দফা শুনানি শেষে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মার্চ আপিল বিভাগ ১৩ তমদের নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখার আদেশ দেন। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সে রায় প্রকাশ পায়। রায় প্রকাশের পর এনটিআরসিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন তা রিভিউ আবেদন করেন। সে রিভিউ আবেদন এখনো শুনানি হয়নি বলে এনটিআরসিএর একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের বার্তাকে নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু রিভিউ চলমান অবস্থায় অর্থাৎ বিচারাধীন অবস্থায় ২ হাজারের বেশি প্রার্থীকে নিয়োগ সুপারিশ করে এনটিআরসিএ। এর মাধ্যমে রিট করে শিক্ষক হওয়া শুরু হলো।

কেন বিচারাধীন পদে নিয়োগ: কেন বিচারাধীন পদে নিয়োগ দেওয়া হলো সে প্রশ্নের উত্তরে দৈনিক আমাদের বার্তাকে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য দিয়েছেন এনটিআরসিএর এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এনটিআরসিএ-এর একজন সদ্য সাবেক উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা এ নিয়োগকে প্রভাবিত করেছেন। তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পরেও নিয়োগ সুপারিশ করা পর্যন্ত পদ ছাড়েননি। বিচারাধীন এ পদগুলোতে নিয়োগ সুপারিশ করতে তিনি অনেক জুনিয়র কর্মকর্তাকে চাপ দিয়েছেন। এনটিআরসিএতে কর্মরত একজন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাকে হয়রানিও করেছেন তিনি। তিনি আরও জানান, ওই কর্মকর্তা ১৩তম নিবন্ধিতদের মামলা শুনানির সময় আদালতে তাদের সাথে আঁতাত করেন। মামলার প্রতিপক্ষকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। মামলার প্রতিপক্ষের লোকজনকে তিনি সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার খাইয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, নিয়োগ সুপারিশের আগের একটি সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভুল বোঝানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে, ১৩তম নিবন্ধিতদের নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব মোমিনুর রশিদ আমিন বদলি হওয়ার আগে এ পদগুলো সংরক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের বলা হয়, এ পদগুলোতে সুপারিশ না করলে গণবিজ্ঞপ্তির ফল দেওয়া যাবে না। এ জন্য ফল প্রকাশে দেরিও করা হয়েছিল।

রিভিউ শুনানি হলে এনটিআরসিএ-এর জয়ের সম্ভাবনা ছিল জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, আদালত ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর ১৬৬টি মামলার যে রায় দিয়েছেন তাতে মেরিটে নিয়োগের কথা বলা আছে। কিন্তু ১৩তমদের রায়ে একক নিয়োগের কথা বলা আছে। দুটি বিষয় সাংঘর্ষিক। বিষয়টি ঠিকভাবে উপস্থাপিত হলেই এনটিআরসিএ রায় রিভিউ পেত। সরকারি টাকা খরচ করে রিভিউ ও তা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হলো না।

এদিকে কেন এ নিয়োগ তা নিয়ে দৈনিক আমাদের বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন এনটিআরসিএ-এর সদস্য এবিএম শওকত ইকবাল শাহীন। তিনি জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই আমরা এ পদগুলোতে নিয়োগ সুপারিশ করেছি। ৩০ জুন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আনোয়ারুল হক স্বাক্ষরিত একটি আদেশে এ পদগুলোতে নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে নির্দেশনা অনুসারেই নিয়োগ সুপারিশ করা হয়েছে।

পদগুলো বিচারাধীন তবুও কেন নিয়োগ এমন প্রশ্নের জবাবে এনটিআরসিএ-এর এ সদস্য বলেন, আমরা রিভিউটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না। তাহলেই হবে। রিভিউ আবেদন এখনো পেন্ডিং জানিয়ে তিনি বলেন, করোনাকালে ভার্চুয়াল কোর্টে রিভিউ আবেদন শুনানি হচ্ছে না।

যেভাবে রিট করে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ: ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবরের পরিপত্র জারি হওয়ার পরে ১৩, ১৪, ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনে ১৭ হাজার ২৫৪ প্রার্থী, ১৪ তম শিক্ষক নিবন্ধনে ১৮ হাজার ৩১২ জন প্রার্থী ও ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনে ১১ হাজার ১৩০ জন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। সে হিসেবে মোট ৪৬ হাজার ৬৮৮ জন প্রার্থী একই নিয়মে নিবন্ধিত হয়েছেন। একই নিয়মে নিবন্ধিত হয়ে ২ হাজারের বেশি প্রার্থী সুপারিশ পেয়েছেন, কিন্তু বাকি ৪৪ হাজারের বেশি প্রার্থী কি নিয়োগ সুপারিশ পাবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে এনটিআরসিএ-এর সদস্য এবিএম শওকত ইকবাল শাহীন বলেন, আদালত যদি নির্দেশনা দেয় আমরা তা পালন করব।

এদিকে, আইনজীবীরা বলছেন, সাধারণ নিবন্ধিতরা যদি ১৩তম নিবন্ধিতদের রায় উদাহরণ দেখিয়ে রিট করেন সে ক্ষেত্রে তারা নিয়োগ সুপারিশের রায় পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের প্রেক্ষিতে সমপর্যায়ের ও সমযোগ্যতার প্রার্থীরা চাকরির ক্ষেত্রে কোন সুবিধা পেয়ে থাকলে তা উল্লেখ করে রিট আবেদন করলে বাকিরাও একই নির্দেশনা পেতে পারেন। একই নিয়মে পাস করা প্রার্থীরা ১৩তম নিবন্ধিতদের নিয়ে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিষয়টি শুনানিতে উপস্থাপন করলে আদালত একই নির্দেশনা পেতে পারেন। তাই বাকিরাও শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পাবেন।

তিনি দৈনিক আমাদের বার্তাকে আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের রায়ের প্রেক্ষিতে সমপর্যায়ের ও সমযোগ্যতার প্রার্থীরা আবেদন না করলেও আদালত সবার ক্ষেত্রে একই নির্দেশনা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিতে পারেন।

১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ ননরিটকারী প্রার্থীরা যা বলছেন: ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ননরিটকারীরা রিট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানিয়েছেন। সাইফুল্লাহ নামে ১৩তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণ ননরিটকারী এক প্রার্থী দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে রিট করিনি। কিন্তু সুপারিশও পেলাম না। সরকার ১৩তম নিবন্ধন পরীক্ষার সময় প্রার্থীদের নিয়োগ সুপারিশের আশ্বাস দিয়েছিল। আমাদের নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হলেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমাদের থেকে কম নম্বর পেয়েও নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন রিট করা প্রার্থীরা।

ইতোমধ্যে রিটের লাইন: এনটিআরসিএ-এর কর্মকর্তারা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানিয়েছেন, বিচারাধীন ২ হাজারের বেশি রিটকারী নিয়োগ পাওয়ার পর রিটের লাইন লেগেছে। ইতোমধ্যে ১৩তম প্রার্থীরা রিট করেছেন। ১৪তম প্রার্থীরাও রিট করেছেন। ইতোমধ্যে এনটিআরসিএ-এর বিরুদ্ধে ৪ শতাধিক মামলা আছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

বিচারাধীন পদে নিয়োগ সুপারিশে টাকা লেনদেনের অভিযোগ ও এনটিআরসিএ-এর বক্তব্য: আপিল বিভাগের রায়ের দোহাই দিয়ে ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও সেই রিটে অংশ নেওয়া নিয়োগপ্রত্যাশী দুই হাজারের বেশি প্রার্থীর মধ্যে অনেকের কাছ থেকে নিশ্চিত নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত তুলে নিয়েছে চক্রটি।

টাকা দেওয়া নিয়োগ প্রত্যাশীরা ফল প্রকাশের আগেই জানতে পারছেন তারা কোন পদে কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশ পাচ্ছেন। আদালতের দোহাই দিয়ে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে চলেছে অবৈধ বাণিজ্য। সাধারণ প্রার্থীরা বিষয়টি তদন্ত করার দাবি জানালেও অজানা কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

জানা গেছে, ১৩তম প্রার্থীদের নিয়োগ সুপারিশ করতে রায় দিয়েছিল আপিল বিভাগ। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মার্চ দেয়া সেই রায়ে আপিল বিভাগ ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২ হাজার ২০৭ জনকে নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশনা দেয়। তবে সে সময় এনটিআরসিএ-এর কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ১৬৬টি রিটের রায়ে এনটিআরসিএকে সমন্বিত মেধাতালিকা করে নিয়োগের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আদালত ১৬৬টি রিটের শুনানিতে এক নির্দেশনা দিলেও পরে ১৩তম নিবন্ধনের প্রার্থীদের করা রিটের আদেশে রিটকারীদের নিয়োগের নির্দেশনা দিয়েছে। দুই রকম নির্দেশনা থাকায় নিয়োগ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় আপিল বিভাগের রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করেছে এনটিআরসিএ। রিভিউ আবেদনের নম্বর ১৯৫/২০২০।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,আপিল বিভাগের রায়, রিভিউ আবেদন ও গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে যে দুই হাজার ২০৭ জন প্রার্থীকে নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাদের জন্য পদ সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছিল আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই কর্মকর্তারা প্রার্থীদের একটি চক্রের সাথে আঁতাত করে এই ২ হাজার ২০৭ জন প্রার্থীকে নিয়োগ সুপারিশ করেছেন। পদ সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর প্রার্থীদের আবেদনও নেওয়া হয়েছে। বিচারাধীন থাকা পদগুলোতে তড়িঘড়ি করে নিয়োগ সুপারিশ করা হয়েছে।

এনটিআরসিএর সদস্য এবিএম শওকত ইকবাল শাহীন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাতেই আমরা পদগুলোতে নিয়োগের সুপারিশ করেছি। ৩০ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের লিখিত নির্দেশনা দিয়েছে। অনেক আলোচনা করে এ সুপারিশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ‘আমরা এতো কাঁচা কাজ করি না’ বলেও মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।

তিনি আরও জানান, কোন কর্মকর্তা যদি টাকা লেনদেন করে সে বিষয়ে প্রার্থীরা অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। প্রার্থীরা নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন। অভিযোগ না দিলে আমাদের কিছুই করার নেই।

এনটিআরসিএর সাবেক কর্মকর্তারা যা বলছেন: এনটিআরসিএর এক সাবেক চেয়ারম্যান এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, এ নিয়োগের মাধ্যমে রিট করে শিক্ষক হওয়া শুরু হলো। ফলে সাধারণ প্রার্থীরা পদ পাবেন না। সাধারণ প্রার্থীরা শত শত আবেদন করে নিয়োগ সুপারিশ পাচ্ছেন আর রিটকারীদের করা লাগছে একটি আবেদন। আর একটি রায় বাস্তবায়ন হয়েছে এই যুক্তি দেখিয়ে রায় পাবেন অন্যরাও। এক রায় বাস্তবায়ন করে একই বিষয়ে আরেক রায় বাস্তবায়ন না করার নজির নেই। সে হিসেবে যারাই রিট করবেন আগের রায়ের উদাহরণ টেনে তারাই নিয়োগ সুপারিশের রায় পাবেন। ২ হাজার প্রার্থীর রায় বাস্তবায়ন করা হলে বাকি প্রার্থীদের রায়ও বাস্তবায়ন করা হবে। এর মাধ্যমে রিট করে শিক্ষক হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হলো।

পদ না থাকলে কী হবে জানতে চাইলে সরকারের সাবেক এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ২ হাজারের বেশি প্রার্থীদেরও পদ দিতে পারেনি। ৬৫ জনকে পরে নিয়োগের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সেভাবেই পদ না থাকলে আশ্বাস দেবে। সাধারণ নিবন্ধিত যারা ভালো নম্বর পেয়েছেন তারা বঞ্চিত হবেন। আর রিটকারীরা নিয়োগ সুপারিশ পাবেন। এর মাধ্যমে প্রচলিত বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার হাঁটু ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।

যদিও সার্বিক বিষয়ে এনটিআরসিএ-এর চেয়ারম্যান এনামুল কাদির খান দৈনিক আমাদের বার্তার কাছে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সূত্র: দৈনিক আমাদের বার্তা। ২৩ আগস্ট। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014900922775269