বৈশাখ একটি সাম্যবাদী উৎসব

মাজহার মান্নান |

হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, এবং মুসলিমরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসবগুলো  অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকে। কিন্তু এই সবগুলো ধর্মের মানুষ  আবার একত্রে একটি উৎসবে যোগদান করে| সেটা হল পহেলা বৈশাখ। যেহেতু সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ এই উৎসবে যোগদান করে, তাই এটিকে সর্বজনীন বা সাম্যবাদী উৎসব বলা যায়। এক মহা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন রচিত হয় বৈশাখি মঞ্চ থেকে। আমাদের সংস্কৃতির এক বিরাট সংযোজন হলো পহেলা বৈশাখ। এটা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমতাসাধক, ধারক এবং বাহক। কিন্তু এই বৈশাখি উৎসব নিয়ে কিছু গোঁড়া, অন্ধ এবং উগ্রবাদী গোষ্ঠীর অপপ্রচার দৃশ্যমান, যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। রমনার বটমূলে হামলা শুধু বৈশাখি উৎসবের ওপরই ছিল না, এটি ছিল সাংস্কৃতিক সমতার ওপর এক বিরাট আক্রমণ। যে সাম্যবাদকে বৈশাখ ধারণ করে, সেটাকে  ভিন্ন খাতে পরিচালিত করা চেষ্টা বারবার দেখা গেছে। কিন্ত কেন? বৈশাখ তো একটি শান্তিপূর্ণ উৎসব। এই উৎসবটি রাষ্ট্রের সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এই উৎসবটি হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও প্রমাণ করে দিয়েছে মানুষের সাথে মানুষের বৈষম্য নেই। বৈষম্যহীন দর্শনই যে বৈশাখের প্রাণ।

বৈশাখকে আপাতত দৃষ্টিতে একটি উৎসব বা বিনোদন মনে হলেও এর রয়েছে আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। বৈশাখকে ঘিরে গ্রাম বাংলার কুটির শিল্পে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। বৈশাখি মেলায় বিভিন্ন পণ্যের বিক্রি হয়ে থাকে, যা আমাদের অর্থনীতির চাকার গতিকে আরো মসৃণ করে। বৈশাখি উৎসবের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি চাকরিজীবীদের বৈশাখি ভাতা চালু করা হয়েছে। এর ফলে চাকরিজীবীরা আর্থিকভাবে কিছুটা হলেও সুবিধাপ্রাপ্ত হন। উৎসব ভাতার  এই টাকা চলে যায় মার্কেটে। বৈশাখি নানা সাজের পোশাক শিশু,  কিশোর ও মহিলারা কিনে থাকেন। বৈশাখি মেলায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কিছু অর্থ উপার্জনের সুযোগ পান। এছাড়াও হালখাতা করে গ্রামের ব্যবসায়ীরা তাদের বকেয়া তুলে নেন। দেনাদারকে মিষ্টিমুখ করিয়ে বকেয়া আদায়ের এই উদার সংস্কৃতি তো বৈশাখেরই উপহার। খাবার ব্যবসায়ীরাও দারুণ ব্যবসা করার সুযোগ পান এই দিনে। এটাতো গেলো বৈশাখের আর্থিক দিক। বৈশাখের সামাজিক মূল্য অপরিসীম। একটি সমাজে বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিভিন্ন আদর্শের মানুষ বাস করে। কিন্তু বৈশাখ এমন একটি উৎসব যেখানে শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, বনিতা, ধনী, গরীব সকলে একসাথে একই উদ্দেশ্য নিয়ে যোগদান করে। ধনী, গরীব, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ শিশুরা একই নাগরদোলায় চড়ে দোল দেয় এবং একই সুরে আনন্দ চিৎকার করে। এর ফলে সামাজিক বন্ধন দৃঢ হয়। বৈশাখের সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে অনেক ভিন্নমত পোষণ করেন কিন্তু এর মাঝে যে সাম্যের সুর লুকিয়ে আছে সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

মঙ্গল শোভাযাত্রা একত্বের প্রতীক, সমতার প্রতীক, ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতির প্রতীক। বৈশাখ বছের একবার আসে কিন্তু এটি সারা বছরের গণ আনন্দকে ত্বরান্বিত করে। বৈশাখের সাহিত্য মূল্য বহুমাত্রিক। বৈশাখ নিয়ে রচিত কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, গান বাংলা সাহিত্যের একটি ক্রনিক সংযোজন। এই দিবস এবং উৎসবকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনন্য কাব্য ও গান রচনা করেছেন। বৈশাখ এমন একটি উৎসব যেটাকে রাজনীতিকীকরণের সুযোগ নেই। এটি গণমানুষের উৎসব। পান্তা ইলিশ দিয়ে সকাল শুরু করার রেওয়াজ বহু পুরোনো। বাঙালি যে আনন্দ করতে জানে শত কষ্টের মাঝেও বৈশাখ তার বড় প্রমাণ। সকল কষ্টকে পিছে ঠেলে আনন্দস্রোতে ভাসতে চায় বাঙালি। বৈশাখ মনের কষ্টকে একদিনের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয়। বৈশাখের বহুমাত্রিক অবদান বাঙালি জীবনকে করে তোলে অর্থবহ এবং প্রাণরসে ভরপুর। সম্রাট আকবর এই দিবসটি চালু করেন বাঙালি সংস্কৃতিকে অধিকতর সমৃদ্ধ করতে। বৈশাখের সাথে বাংলা ভাষার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা  বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে নতুন কিছু হওয়ার আশা নিয়ে। 

ভারত ও বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের কাছে এই দিন বড়ই আনন্দের। ভাষা একটি সংস্কৃতিকে ডোমিনেট করে। বাংলা ভাষা তাই বৈশাখের প্রাণ।মাতৃভাষায় রচিত লোকসঙ্গীত বৈশাখকে দিয়ে থাকে এক ভিন্ন রূপ। বৈশাখে বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মিষ্টি আর পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। বৈশাখে অতিথি আপ্যায়ন করা বাঙালিদের একটি বড় রেওয়াজ। বৈশাখের প্রায়োগিক দিক যেমন আছে তেমনি আছে এর প্রতীকী দিক। বৈশাখের সাথে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। যদিও কেউ কেউ বিরোধ খোঁজার চেষ্টা করে থাকেন। এ ধরণের লোক সব কালেই থাকে। দুধ-ভাতেও কাঁটা খোঁজার কিছু লোক সব সময় থাকে। তাতে কিছু যায় আসে না। বৈশাখ শান্তির প্রতীক, সাম্যের প্রতীক, শুদ্ধতার প্রতীক। বৈশাখ এমনই এক আয়োজন যেটার মূল সুর হলো ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। বাংলাদেশের অন্য কোনো উৎসব সব মানুষকে একত্র করতে পারে না, কিন্তু বৈশাখ সেটা খুব সহজেই পারে। বৈশাখ একটি অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন লোক উৎসব। বৈশাখ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলেছে।২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে '' মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য'' হিসাবে ঘোষণা করে। ইউনেস্কো এটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। শোভাযাত্রায় গ্রামীন জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক চেতনার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বৈশাখ সেই সাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে আঘাত হানে।

পাকিস্থান রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচারকে নিষিদ্ধ করে সাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিয়েছিল।  কিন্তু বাঙালি সেটা মানেনি। বৈশাখ উদযাপন করে সেটার প্রতিবাদ করেছে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজিয়ে এর প্রতিবাদ করা হয়। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ছায়ানট ১৫ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো বাজিয়ে এবং গেয়ে বৈশাখকে বরণ করে নেয়া হয়। আর এর মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রকাশ পায়। হিন্দু - মুসলিম সংস্কৃতির এক দারুন মেলবন্ধন তৈরি হয়। বৈশাখ নিয়ে অপপ্রচার কম হয়নি কিন্তু বৈশাখের গায়ে এটি একটুও আঁচড় কাটতে পারেনি। বৈশাখ কখনোই গোষ্ঠী চেতনায় বন্দি হয়নি। মুক্ত চেতনার ধারক ও বাহক হিসাবেই থেকে গেছে। যাহোক বাংলা বর্ষবরণ বাঙালি ঐতিহ্যের একটি বড় অংশ। মহাসমারোহে, সাড়ম্বরে, উৎসাহ এবং উদ্দীপনার  মাধ্যমে এই দিনটিকে বাঙালি স্মৃতির পাতায় রেখে দিতে চায়। নতুন বছরের উদযাপনের সঙ্গে গ্রামীন জীবন, কৃষ্টি, সংস্কৃতির নব নব  বন্ধন তৈরি হয়।

উৎসবের এই দিনে ঘর সাজানো, নতুন পোশাক পরা, বিভিন্ন ধরণের পিঠা, পায়েস, মিষ্টি আর খাবার তৈরি করা, আপ্যায়ন করা, দলবেধে মেলায় যাওয়া, অনুষ্ঠান উপভোগ করা, খেলার আয়োজন করা সহ বিভিন্ন রীতি আর রেওয়াজে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বাংলা মাসের এই প্রথম দিনটি। নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তি সহ নানান খেলায় মেতে উঠে গ্রামের মানুষ। আদিবাসীরা বর্ষবরণ একটু ভিন্ন আঙ্গিকে করে   থাকে। তারা বৈসাবি উৎসব করে থাকে। মারমা সম্প্রদায় বৈশাখে পানি উৎসবে মেতে উঠে। যাহোক সমগ্র বাংলায় বৈশাখি মেলা ভাতৃত্বের এক নব ব্যঞ্জনা তৈরি করে। অনেকে আবার টক ও তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা বর্জন করে প্রতীকীভাবে। ছোটরা বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে এই দিনে যার ফলে তৈরি হয় শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালোবাসা আর সম্প্রীতির বন্ধন। শুধু বাংলাদেশ আর ভারতেই নয়, প্রবাসী বাঙালীরা বৈশাখ উদযাপন করে বিশ্বের নানা প্রান্তে বসে। বিদেশীরা প্রবাসীদের এই উৎসবে যোগ দেয় এবং বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত হয়। বৈশাখ আমাদের সবার। কোনো ধরণের হীনস্বার্থে আমরা যেন এর গায়ে কলঙ্ক না লাগাই। 

লেখক : কবি ও কলামিস্ট


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023820400238037