বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সুবর্ণ জয়ন্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মঙ্গলময় বারতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দৃষ্টি কেড়েছে। কৃষি, পোশাকশিল্প আর প্রবাসী কর্মীরা বাংলাদেশের উন্নয়নে যেমন ভূমিকা রাখছেন, তেমনি কয়েক বছর হলো বাংলাদেশ একটি স্বর্ণ অধ্যায়ে পা দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা যাকে বলছেন, ‘জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশ (demographic dividend)’ অর্জনের অধ্যায়। দেশের জনসংখ্যার অবয়ব পরিবর্তন মূলত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মৃত্যুহার দুটিই কমে গেলে এবং কর্মক্ষম জনসংখ্যা অকর্মক্ষম জনসংখ্যার থেকে বেশি হওয়ার কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে ‘জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশ’ একটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হিসেবে প্রতীয়মান হয়। বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, সমাজবিজ্ঞানীরা আরো একটু খোলাসা করে বলছেন, কর্মক্ষম ১৫ থেকে ৬৪ বছরের জনসংখ্যা অকর্মক্ষম ১৪ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের ওপরের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি হলে এটিকে ‘জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশ’ বলা যায়। আর ‘জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশ’ থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে দরকার সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা আর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শাসনব্যবস্থা পরিচালনা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঠিক পরিকল্পনা, নীতিনির্ধারণ ও এর বাস্তবায়ন করা।

বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশ (প্রায় পৌনে ১১ কোটি) আর জনসংখ্যার উর্বরতার হার ১.৯৮ শতাংশ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ এখনো কর্মহীন। বাংলাদেশের সামনে রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণী ও কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে এমন অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি নিয়ে অনেক সুখকর পূর্বাভাস দিয়েছে। কিন্তু এই পূর্বাভাসগুলো বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য চাই এই বিশাল কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে কর্মহীন মানুষকে কর্মজীবীতে রূপান্তর সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হলো কর্মক্ষম এবং যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য সঠিক ও চৌকস পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণ ছাড়া কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সঠিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।

যে জরুরি বিষয়টি সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে সেটি হলো দক্ষ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তৈরি করা। আর সে জন্যই দরকার সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করা—যে শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ নিজেকে কাজের জন্য প্রস্তুত ও যোগ্য করে তুলতে পারবে, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে নিজেকে একীভূত করবে। মূলত ‘জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশ’কে ‘শিক্ষাবিষয়ক জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশে’ পরিবর্তন করা না গেলে আমাদের বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যা মূল্যহীন হয়ে পড়বে।

দীর্ঘদিন পরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মতবিরোধ ও বিতর্ক নিরসনের আলোটা জ্বলে উঠেছে। সম্প্রতি শিক্ষার্থী মূল্যায়নে পরিবর্তন এনে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রমের পরিবর্তনের কথা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। বলা হয়েছে পুরো শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, আনন্দময় ও সহনীয় বিষয়ভিত্তিক চাপের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা জানতে পারিনি এই শিক্ষা কার্যক্রম কতটুকু যুগোপযোগী হবে এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য একজনকে প্রস্তুত করবে? আর এর জন্য পদ্ধতিগত কতটুকু নতুনত্ব থাকবে নতুন শিক্ষাক্রমে?

আজ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হলো উঁচু পর্যায়ের মননশীলতা ও বৈশ্লেষিক দক্ষতা গঠনের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃত জগতের সংযোগ ঘটানো। আর এ জন্য  STEM (Science, Technology, Engineering and Mathematics)  শিক্ষাপদ্ধতিকে উন্নত বিশ্বে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে।

STEM শব্দের সঙ্গে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং অঙ্কের সংযোগ রয়েছে বটে; কিন্তু এই বিষয়গুলো সরাসরি পাঠদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এটা মূলত একটি সমন্বিত পদ্ধতি। পেশাবৃত্তির লক্ষ্য এবং বিষয়ভিত্তিক আগ্রহকে ধারণ করেই শিক্ষার্থীরা  STEM-এর মাধ্যমে সহযোগিতা, যোগাযোগ, গবেষণা, সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধান, সংকট বিশ্লেষণ, সৃষ্টিশীলতাসহ অন্যান্য দক্ষতা বিকাশের সুযোগ পায়। তা ছাড়া উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতি মুহূর্তের বিকাশমান পৃথিবীতে নতুনত্ব বা নতুনের প্রবর্তনের বিকাশ এবং ধারণ করার জন্য শিক্ষার্থীর মানসিক প্রস্তুতি বাড়াতে শিক্ষাক্রমে থাকছে অনুষঙ্গ।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিংবা আদলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাতে না পারলে আমরা যেমন অন্যদের মতো করে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারব না, তেমনি দক্ষ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তৈরিতে ব্যর্থ হব। এর অর্থ হলো বাংলাদেশে জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশের সদ্ব্যবহারের যে সুযোগ এসেছে তা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে যাব। তা ছাড়া আমাদের সমাজে যে নৈতিক অসংগতি রয়েছে তা ঘুচবে না। তাই আমাদের পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণ প্রণয়নে অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে।

একজন অতি সাধারণ নাগরিক হিসেবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশ বিগত ৫০ বছরে, বিশেষ করে গত এক যুগে যেভাবে এগিয়েছে তা অনেকটা জাদুর মতোই। দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের লালিত স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে এগোচ্ছেন, আমরা মনে করি সেই আলোতে শিক্ষামন্ত্রী একটি অত্যন্ত আধুনিক এবং ফলপ্রসূ শিক্ষা কার্যক্রম তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশের সুফল অর্জনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন।

 

লেখক : ড. এজাজ মামুন, প্রবাসী বিজ্ঞানী, কলামিস্ট


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056769847869873