দেশে শিক্ষা বিষয়ে যে কোনো আলোচনায় এর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শিক্ষার সব শেষ স্তর এবং জাতীয় আয়ের বড় একটা অংশ এর জন্য ব্যয় করতে হয় বলে আলোচনা বেশি হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে। প্রায় সময়ই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোথায় অবস্থান করছে সে প্রশ্নও ওঠে। ইদানীং সমালোচনাও হচ্ছে, যা হওয়াই স্বাভাবিক। মানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, স্বজনপ্রীতি, শিক্ষক নিয়োগে নির্দিষ্ট দলের প্রতি পক্ষপাত-এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা হয় সরকারি ও নাগরিক পরিসরে।
তবে সবচেয়ে কঠিন অভিযোগ করলেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ১৭ সেপ্টেম্বর এক আলোচনাসভায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ব্যক্তিত্বহীনতার প্রসঙ্গ তুলেছেন। তার ভাষায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বে যেসব শিক্ষক আছেন, তারা সেখানকার প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের কথায় উঠেন আর বসেন। আরেকটি অভিযোগ করেছেন- প্রভাবশালীদের তদবিরে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। জনাব কাদেরের দুটি অভিযোগই গুরুত্বপূর্ণ, তবে প্রথমটি তুলনাবিচারে বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ডিন, হল প্রভোস্ট-হাউজ টিউটর, প্রক্টর-সহকারী প্রক্টররা সরাসরি দায়িত্ব পালন করেন। এর বাইরে বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের প্রধানরা আছেন। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। অন্যান্য পদের ব্যক্তিরা উপাচার্য দ্বারা নিয়োজিত হন। জনাব ওবায়দুল কাদেরের কথা থেকে মনে হয়, প্রশাসনের সবাইকে তিনি যৌথভাবে ব্যক্তিত্বহীন বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ব্যাপারে সরকারের কাছে উপাচার্যরা দায়ী থাকেন। উপ-উপাচার্যরা উপাচার্যের কাছ থেকে অর্পিত (delegated) ক্ষমতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন এবং তার কাছে দায়ী থাকেন। ডিন নির্বাচিত একটি পদ। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো যৌথ দায়িত্ব থাকার কথা নয়। একমাত্র উপাচার্যই সরকারের কাছে দায়ী। তার ব্যর্থতায় তিনি পদত্যাগ করতে পারেন বা সরকার তাকে সরিয়ে দিতে পারে।
ব্যক্তিত্বহীন কথাটার মধ্যে এক ব্যক্তির স্বকীয়তাহীনতার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। যিনি তার চিন্তা-আচার-আচরণ-মতপ্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজস্ব বিবেচনা দ্বারা পরিচালিত, তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তিনি অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবেন না। কিন্তু যিনি তা পারেন না, তিনি ব্যক্তিত্বহীন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এক অভিন্ন সত্তা ধরে প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠবস করার অভিযোগ তুলে সব শিক্ষককে এক কাতারে ফেলা হলে তাদের হেয় করা হয় বলে মনে করি। তাদের মধ্যে অনেক ব্যতিক্রম থাকতে পারেন। তবে আমি বলছি না, সব প্রশাসকই একইরকম ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ছাত্রনেতাদের তোয়াজ করে বা তাদের সন্তুষ্ট করে প্রশাসন পরিচালনার উদাহরণ অনেক আছে। অন্যদিকে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে তার অভিযোগে আমি মনে করি সততা আছে।
আমার প্রশ্ন, তার ভাষায় এসব ব্যক্তিত্বহীন, ছাত্রনেতার কথায় ওঠবস করা শিক্ষকরা কেন এ রকম করেন? প্রশাসকরা কি সবসময় এ রকম ছিলেন? আগেই বলা হয়েছে, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যরা সরকারের দ্বারা নিয়োজিত হয়। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী সিনেট সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত প্যানেল থেকে উপাচার্য নিয়োগ করার নিয়ম আছে। প্রথমদিকে তা নিয়মিত হলেও পরে সে নিয়ম আর অনুসরণ করা হচ্ছে না। যেমন-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ কবে সিনেট নির্বাচিত উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছেন, তা মনে হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকদেরও অনেকে মনে করতে পারবেন না। রাজশাহীও এর ব্যতিক্রম নয়। প্যানেলের সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া শিক্ষকই যে নিয়োগ পান, তা সবসময় হয় না। তার মানে সরকারের কাছে কে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সেটাই আসল মাপকাঠি। গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি হিসাবে নিশ্চয়ই পাণ্ডিত্য থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় দলের প্রতি আনুগত্য।
তাহলে সরকারের নিয়োজিত ব্যক্তি যদি ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠবস করেন, তার দায় তো সরকারের ওপরই বর্তায়। তারা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন, যিনি ন্যায়নীতিবিবর্জিত হয়ে ছাত্রনেতা নামধারী মেধাহীন ব্যক্তিদের কাছে নতিস্বীকার করেন? প্রাসঙ্গিকভাবে বলা দরকার, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের যুগেই এটি চালু হয়েছে তা বলার কোনো কারণ নেই। কম-বেশি আগের সরকারের সময়ও উপাচার্যরা বিভিন্ন প্রভাবের কাছে নতিস্বীকার করতেন। আজকাল বিশেষ পছন্দের প্রার্থীকে শিক্ষক করার জন্য চাপের কথা শোনা যায়। অবশ্য শুধু তথাকথিত ছাত্রনেতারাই নন, ক্ষমতাসীন নেতাদের চাপ থাকে। কাদের সাহেব তাহলে কীভাবে শুধু শিক্ষকদের দোষী করছেন?
এটা ঠিক, জনাব কাদেরের অভিযুক্ত উপাচার্য ও অন্য প্রশাসকরা সংখ্যায় দিন দিন বাড়ছে। আমার দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ভেতর প্রয়াত প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরীকে আমি সবসময় স্মরণ করব এমন একজন প্রশাসক হিসাবে, যিনি প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। একাডেমিক কাউন্সিলের সভা তাকে যেভাবে পরিচালনা করতে দেখেছি, তা তার নেতৃত্বগুণের পরিচয় দিয়েছে। তাছাড়া প্রয়াত প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ এবং বর্তমান ইমেরিটাস অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীও আমার বিবেচনায় পাণ্ডিত্য ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন ছিলেন।
এটি ওপেন সিক্রেট যে, দলীয় বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে অনেকদিন ধরেই। যে গণতন্ত্রচর্চার কথা বলে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ শিক্ষকরা পেয়েছিলেন, তার চরম অপব্যবহার তারা নিজেরাই করেছেন। উপাচার্যসহ বিভিন্ন পর্ষদে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে অনেক আগেই। সবচেয়ে প্রভাবশালী পর্ষদ সিন্ডিকেটে শিক্ষকরা লেকচারার থেকে অধ্যাপক এবং ডিন ও প্রভোস্ট পদে ভোটের মাধ্যমে নিজ নিজ প্রতিনিধি ঠিক করেন। কিন্তু লেকচারার, সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকরা নির্বাচিত হওয়ার পর পদোন্নতি পেয়ে উপরের পদে নিয়োগ পেলে সিন্ডিকেটে তাদের শূন্য পদে আর কখনও উপনির্বাচন হয় না। কোনো প্রশাসনের সময়ই তা করা হয় না। সিনেটের নির্বাচনকে নানা কারণে আটকে রেখে প্যানেলের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ বিধিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ডিনের পদ শূন্য হলে কোনো উপনির্বাচন করা হয়নি। সরকারের প্রশ্রয়ে বা অবহেলায় অধ্যাদেশকে এভাবে অবজ্ঞা করা হয় বছরের পর বছর। স্বায়ত্তশাসনের বর্মকে অন্যায্যভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
উপাচার্য পদে নিয়োগ পেতে সুযোগসন্ধানী শিক্ষকরা ছাত্রনেতাদের যেমন ব্যবহার করেন, তেমনি ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য পেতেও চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না। কেউ কেউ আঞ্চলিকতার আশ্রয় নেন, কেউ রাজনৈতিক নেতার নির্বাচনী সভায় উপস্থিত থেকে প্রচারে সাহায্য করেন, দেখা গেছে। সুতরাং শিক্ষকদের ব্যক্তিত্বহীন করতে যে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা আছে, তা জনাব ওবায়দুল কাদের অস্বীকার করবেন কি? শিক্ষক নিয়োগে মেধাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি দলীয়, মেরুদণ্ডহীন ও চাটুকার শিক্ষক বেশি থাকেন, তাহলে ক্ষমতাসীনদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করা কত সহজ হয়। যেমন, তাদের প্রয়োজন দলীয় এবং যুক্তিতে অবিশ্বাসী ও ঔদ্ধত্য মানসিকতার ছাত্রদের। শিক্ষক রাজনীতিতে অনেকদিন ধরে একটা কথা প্রচলিত আছে-শিক্ষক নিয়োগের তুলনায় দলীয় ভোটার নিয়োগ বেশি গুরুত্ব পায়। তা করতে গিয়ে মেধাবীদের তুলনায় নিকৃষ্ট প্রার্থীরা সুবিবেচনা পায় বেশি। এখন আবার যোগ হয়েছে পুত্র, কন্যা ও জামাই নিয়োগ করার চল।
বিশ্ববিদ্যালয় নামের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অবক্ষয় গত ত্রিশ বছরে যেভাবে হয়েছে, আগে তা হয়নি। এরশাদ সরকারের সময় শিক্ষক নিয়োগ বা ক্ষমতাসীনদের ছাত্রনেতাদের দৌরাত্ম্য আজকের সঙ্গে তুলনীয় ছিল না। ১৯৮৮ সালে বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষক হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রভোস্টসহ আমাদের আবাসিক শিক্ষকদের নৈতিকতার যে জোর ছিল তাতে সিট বণ্টন, ডাইনিং পরিচালনা ইত্যাদি দায়িত্ব পালনে আমরা কোনো বাধা মোকাবিলা করিনি। যদিও তখন হল বঙ্গবন্ধুর নামে হলেও ছাত্রদলের পেশিশক্তির প্রকাশ ছিল। তাদের মোকাবিলা করে আমরা কাজ করার চেষ্টা করেছি।
এখন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করা হয় কীভাবে? এ পদ লাভ করার জন্য আগ্রহী ব্যক্তির মনে হয় কোনো ঘাটতি নেই। নানাভাবে তদবির করার পর যাদের নিয়োগ করা হয়, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অচিরেই বিভিন্নভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়ে। আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, যৌন হয়রানি এবং কর্তব্যস্থলে অনুপস্থিত থাকা-বড় বড় অভিযোগের মুখে তারা সহকর্মীদের বিরোধিতার মুখে পড়ে যান। প্রশ্ন হলো, যিনি বা যারা এসব দোষে দুষ্ট, তারা কীভাবে ছাত্রদের অন্যায্য দাবি অগ্রাহ্য করবেন? কাজেই এসব অযোগ্য ও অনৈতিক শিক্ষকদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।
সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের রং বদল করার রেওয়াজ আছে। অর্থাৎ আগে যিনি সাদা দল করতেন, তিনি এখন অবলীলায় নীল দল করে বিভিন্ন পদ পেয়ে গেছেন। সরকার পক্ষের শিক্ষকদের রং যত বেশি শক্তিশালী হবে, ক্ষমতাসীনদের পক্ষে তত নিশ্চিন্তে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। শিক্ষকরা সারা বছর তাদের বিভিন্ন পর্ষদের নির্বাচনের জন্য ব্যস্ত থাকেন। অথচ মেধাবী ও যুক্তিশীল ছাত্র নেতৃত্ব বিকাশের জন্য ছাত্রসংসদের নির্বাচনের দায়িত্ব নিতে চান না। সরকারেরও আগ্রহ থাকে না। কেননা, সরকারবিরোধী ছাত্ররা সংখ্যায় বেশি হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে মনমতো পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।
জনাব ওবায়দুল কাদেরকে শিক্ষকদের অভিযুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের দায় ও দায়িত্বের কথাও ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হতে হবে। অন্যথায় তার কথা শুধু কথাই থাকবে, কোনো সমাধান বের হয়ে আসবে না। তার কথার মধ্যে চমক আছে বলে হাততালি দেওয়া যায়, কিন্তু প্রশংসা করা যায় না।
ড. আকমল হোসেন : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর।