বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে, বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা এখনো বেশ পিছিয়ে রয়েছি। হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে তো বটেই, আমাদের দেশে বহু স্কুল-কলেজে ব্যাবহারিক বিজ্ঞান শেখানোর সেরকম কোনো আয়োজনই নেই। বহু স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান ভবনই নেই, নেই কোনো ব্যাবহারিক বিজ্ঞান শেখানোর জন্য সস্তা এবং অতিপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও। অনেক স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান ভবন থাকলেও এতে নেই যন্ত্রপাতি, নেই কাজের কোনো পরিবেশ। বুধবার (১৬ জুন) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’
নিবন্ধে আরও জানা যায়,অনেক স্কুলে বিজ্ঞান ভবন থাকলেও এসব রয়েছে তালাবদ্ধ বছরের পর বছর ধরে। যন্ত্রপাতি ছিল কিছু যেসব বিজ্ঞান ভবনে, সেখানেও বহু ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি বিকল থাকায় হচ্ছে না সেরকম কোনো ব্যাবহারিক ক্লাস বা পরীক্ষা। রীতিমতো সুনির্দিষ্ট ব্যাবহারিক শিক্ষার জন্য সিলেবাস থাকলেও ব্যাবহারিক ক্লাস ছাড়াই সম্পন্ন হচ্ছে বিজ্ঞান পড়াশোনা। এমনকি চূড়ান্ত পরীক্ষায় ব্যাবহারিক পরীক্ষা নেওয়ার আয়োজন না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অন্যদের দিয়ে লেখানো ব্যাবহারিক খাতা আর দু-চারটি মৌখিক প্রশ্ননির্ভর হয়ে পড়েছে আমাদের বিজ্ঞান পঠনপাঠন।
তাতে অবশ্য নম্বর পেতে সমস্যা হচ্ছে না আমাদের শিক্ষার্থীদের। তাতে বহুজন পাচ্ছে শতকরা ৮০ ভাগের ওপরে নম্বর। এতে অনেকেই পাচ্ছে গোল্ডেন জিপএ-৫ও। অবস্থাটা এমন, যেন সবই চলছে ঠিকঠাক। এর ব্যতিক্রম যাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। গোটা দেশের প্রেক্ষাপটে তাদের সংখ্যা কম বলে তা আর এখানে উল্লেখ করলাম না।
এরকম যখন আমাদের দেশের অধিকাংশ স্কুল-কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা, তখন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘সরকারি কলেজসমূহের বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্প’ নামে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের ২০০ সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ, বিজ্ঞান অবকাঠামো উন্নয়ন, আইটি সরঞ্জাম এবং উন্নত মানের তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আরো কিছু নির্মাণকাজ ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সরবরাহ করার কথা। উদ্যোগটি যে প্রশংসার যোগ্য, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ প্রকল্পের কাজ কতটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে সেটা দেখার লোক নিশ্চয় কেউ না কেউ রয়েছেন, তবে ৫০ হাজার টাকার ক্যামেরা ৫ লাখ টাকা দিয়ে কেনার যে অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে, সেটাই যেন বলে দিচ্ছে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের কাজটি কেমন চলেছে।
কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ক্যামেরা কেন অতি জরুরি, সেই যুক্তি নিশ্চয়ই প্রকল্পে দেওয়া আছে এবং তা থাকারই কথা। বলা বাহুল্য, কেবল ৫০ হাজার টাকায় এখন সুন্দর ও কার্যকর ডিজিটাল ক্যামেরা পাওয়া যায়। যখন ১ লাখ টাকা দামের মাইক্রোস্কপের অভাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা জীবকোষের ভেতরে কী আছে তা দেখতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং কোষ বিভাজনের জটিল ধাপগুলো বাস্তবে না দেখে মুখস্থ করছে, তখন ৫ লাখ টাকা দামের ডিজিটাল ক্যামেরা কেনা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি একরকম উপহাস করা বলেই মনে হয়। কেবল জীববিজ্ঞান নয়, কোনো বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয় ন্যূনতম যন্ত্রপাতিই নেই দেশের সিংহভাগ স্কুল-কলেজে। অবস্থা যখন এ রকম, তখন পত্রিকার মারফতে জানতে পারলাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই ক্রয় করা হয়েছে এসব ক্যামেরা। দেশের বিজ্ঞান অনুরাগী মানুষের জন্য এসব খবর বড় বেদনার।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন
দেশ যখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল পাওয়ার জন্য সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে এবং নানা রকম সুযোগ-সুবিধা বর্ধন করার কথা ভাবছে, তখন এসব খবর আমাদের হতাশ করে। বিশেষ করে আমরা যারা মনে-প্রাণে বিজ্ঞানকে ধারণ করে দেশব্যাপী অনানুষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ে অলিম্পিয়াড আয়োজন করে যাচ্ছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের কাছে এসব খবর বড় হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ন্যূনতম সরকারি আর্থিক সুবিধা না নিয়ে বা না পেয়ে কায়ক্লেশে আমরা যখন বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড নিয়ে দেশব্যাপী দৌড়ঝাঁপ করছি, তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সহজ করে বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করছি এবং কষ্ট করে এসব প্রকাশের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি, তখন আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান যন্ত্রপাতির অভাব, শিক্ষকদের চরম অনীহা ও অদক্ষতা এবং বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণে প্রকল্প পরিচালকের এ রকম অবহেলা ও ঔদাসীন্য দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য একেবারেই প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়।
আমাদের সবার এ কথা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, বিজ্ঞান শিক্ষা, বিজ্ঞানমনস্কতা, বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান গবেষণা ছাড়া কোনো জাতি কেবল ধার করা জ্ঞান নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারে না। আগামী দিনের বিজ্ঞান অনেক বেশি উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর হবে তা বলাই বাহুল্য। এর সুফল খানিকটা হলেও ঘরে তুলতে হলে আনুষ্ঠানিক হাতে কলমে বিজ্ঞান শিক্ষায় আরো বেশি জোর দিতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে নানা রকম অনানুষ্ঠানিক বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডকেও। এই কদিন আগেই অলিম্পিয়াড আয়োজকদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় এক অনলাইন মতবিনিময় সভায় বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্বের কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন এবং আমাদের অলিম্পিয়াডগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতাদানের কথাও বলেছেন বেশ জোরের সঙ্গেই।
আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রে বিজ্ঞান অনুশীলনের কাজ সমানতালে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ খুঁজে নেওয়া সম্ভব হবে। সে পথ সহজ নয় বটে। তবে বিজ্ঞান নিয়ে হামবড়া ভাব, বড় বড় কথা আর নানা রকম হঠকারী কর্মকাণ্ড বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে কেবল রুদ্ধ করবে তা-ই নয়, আমাদের সামগ্রিক অগ্রগতিকেই তা ব্যাহত করবে।
লেখক : ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া, সভাপতি, বাংলাদেশ বায়োলোজি অলিম্পিয়াড কমিটি