ভারতে পাঠ্য থেকে বাদ পড়া বিষয় নিয়ে অসন্তোষ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

জীববিজ্ঞান, রসায়ন থেকে সমাজবিজ্ঞান— নানা বিষয়ের কেন্দ্রীয় স্কুল পাঠ্যক্রম থেকে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বাদ পড়ে চলেছে। এনসিইআরটি (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং বা রাষ্ট্রীয় শিক্ষা অনুসন্ধান এবং প্রশিক্ষণ পরিষদ)-এর নির্দেশিকা মেনে গত কয়েক মাসে পরিবর্তন ঘটেছে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রমে। কোনও শ্রেণিতে মোগল যুগ বাদ পড়েছে। কোথাও ডারউইনের বিবর্তনবাদ। কোথাও নারী আন্দোলনের ইতিহাস। কোথাও বা ভারতের সামাজিক বৈষম্য। শিক্ষামহল এবং শিক্ষায় আগ্রহী মহল, সর্বত্রই এ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ এবং দৃষ্টিকোণ থেকেই ছেঁটে ফেলার বিষয়গুলি ঠিক করছে। উল্টো মতামত হল, পড়ুয়াদের উপর অকারণ চাপ কমাতেই এই সব রদবদল। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।

কোন শ্রেণিতে কোন কোন অধ্যায় বাদ 

• ষষ্ঠ শ্রেণি: বাদ পড়েছে গণতন্ত্রের মূল কথা, ভারতের জলবায়ু ও বন্যপ্রাণ, খাদ্য ও শক্তির উৎসের মতো বিষয়।
• সপ্তম শ্রেণি: ভারতের সামাজিক অসাম্য ও তার কারণ, নারীদের সমানাধিকারের দাবি, মধ্যপ্রদেশে বাস্তুচ্যুত বনবাসীদের আন্দোলনের ইতিহাসের মতো অধ্যায় বাদ।
• দশম শ্রেণি: রসায়নের পাঠ্যসূচিতে ছিল মৌলগুলির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ (পর্যায় সারণি বা পিরিয়ডিক টেবল)। এটি বাদ পড়ল। সমাজবিজ্ঞানের বই থেকে বাদ পড়েছে তিনটি বিশেষ অধ্যায়— গণতন্ত্র ও বৈচিত্র, বিভিন্ন সুপরিচিত আন্দোলন এবং গণতন্ত্রের পথে নানা বাধা। জীবনবিজ্ঞান থেকে বাদ গেল ডারউইনের বিবর্তনবাদ।
• একাদশ শ্রেণি: দারিদ্র, শান্তি, উন্নয়নের অধ্যায় বাদ পড়েছে। বিজ্ঞানে বাদ পড়েছে পদার্থের বিভিন্ন রূপ।
• দ্বাদশ শ্রেণি: দেশভাগ, ঠান্ডাযুদ্ধ, গুজরাত দাঙ্গা, বংশগতি, মোগল যুগ, গণতন্ত্র অধ্যায় বাদ। বাদ গেল আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ)-কে নিষিদ্ধ করার ইতিহাসও। জীববিদ্যার পাঠ্যক্রম থেকে ছাঁটাই হয়েছে বংশবৃদ্ধি।

শিক্ষাবিদদের অনেকে মনে করছেন, বাদ পড়া অধ্যায়গুলির মধ্যে মূলত একটি ধরন (প্যাটার্ন) রয়েছে। এক সময়ে জগৎ, জীবনের ব্যাখ্যায় প্রাধান্য বিস্তার করত ধর্মীয় তত্ত্ব। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ যুক্তি এবং পরীক্ষানিরীক্ষা নির্ভর ব্যাখ্যার বিস্তার ঘটেছে তার বদলে। বিবর্তনবাদ বা পর্যায় সারণির মতো বিষয় বাদ দিয়ে এই যুক্তির পাঠের গুরুত্বকে লঘু করার চেষ্টা চলছে বলেই এরা মনে করছেন। এদেরই এক জন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তার কথায়, খুবই দুঃখজনক। মানুষের জ্ঞানের পরিধি কমিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা এখন সারা দেশ জুড়ে চলছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

শুধু বিজ্ঞানে নয়, ইতিহাস বা সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দালন, সামাজিক বা আর্থিক অসাম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন বাদ পড়া নিয়েও সরব হয়েছেন শিক্ষাবিদদের একটি অংশ। তারা মনে করছেন, কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদল গেরুয়া শিবিরের ‘অ্যাজেন্ডা’কে রূপ দিতেই পাঠ্যক্রমে এই পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। যদিও এই ধরনের অভিযোগের সঙ্গে একেবারেই একমত নন কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী তথা বাংলার সাংসদ সুভাষ সরকার। তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে যে শোরগোল হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ অবান্তর। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ছাত্র, শিক্ষাজগৎ, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং দেশের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন পরিস্থিতি চিহ্নিত করেই এই (পাঠ্যক্রম) সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর যুক্তি, কোভিড-পর্বের পরে দীর্ঘ দিন পড়ুয়ারা বাড়িতে থাকায় তাদের অধ্যয়ন সমানতালে হয়নি। এই পরিস্থিতিতে এনসিইআরটি নয়া পাঠ্যক্রমে সমতা রক্ষার চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখে দু’টি শ্রেণিতেই রয়েছে এমন পাঠ্যক্রমের পুনরাবৃত্তি এড়ানো হয়েছে। একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা পর্যায় সারণি পড়ার সুযোগ পাবেন জানিয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের পর্যায় সারণি পড়ার কোনও প্রয়োজন নেই।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে অবশ্য এ নিয়ে একেবারেই একমত নন বঙ্গবাসী কলেজের শিক্ষক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, দশম শ্রেণিতে পর্যায় সারণি আমরাও পড়েছি। কখনও ভারাক্রান্ত বলে মনে হয়নি। পর্যায় সারণি না জানলে একাদশে রসায়ন পড়তে গিয়ে অসুবিধা হতে পারে। পর্যায় সারণি ছোট একটা অধ্যায়। আগে থেকে তার কিছুটা জানা থাকলে একাদশ শ্রেণিতে সুবিধা হয় তো বটেই।

দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ বাদ যাওয়ার পর, দেশের ১৮০০-র বেশি শিক্ষাবিদ প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন কেন্দ্রকে। বিরোধীদের অভিযোগ, স্কুলশিক্ষার নিচু স্তর থেকেই গৈরিকীকরণে তৎপরতা শুরু করেছে মোদী সরকার। বিজেপি শিবির অবশ্য মনে করছে, পড়ুয়াদের সুবিধার জন্য যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে, বিরোধীরা নিজেদের রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা এবং স্বার্থ দিয়েই তার বিচার করছেন। 
সূত্র: আনন্দবাজার 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014008045196533