ভালো নেই বাংলাদেশের প্রথম পতাকার কারিগর শিবনারায়ণ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

উত্তাল সত্তরের ৭ জুন। পল্টন ময়দানে জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজে সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানানোর আয়োজন। আগের দিন ৬ জুন বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) নিচতলায় ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রব এবং শাহজাহান সিরাজের রুমে এক জরুরি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চার ডাকসাইটে নেতা- রব, সিরাজ, কাজী আরেফ এবং মার্শাল মনি। জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজের প্রস্তুতির আলোচনা বৈঠকে এই চার নেতা একটি পতাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কক্ষের বাইরে তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলেন ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু, কুমিল্লা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিবনারায়ণ দাশসহ আরো অনেক নেতাকর্মী। ওই চার নেতা বহুদিক বিবেচনা করে লাল-সবুজের মাঝে বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্তের পর আঁকিয়ে শিবনারায়ণ দাশকে পতাকা আঁকতে বলা হলে তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবে পতাকাটি আঁকেন। এরপর পতাকাটি নিয়ে হাসানুল হক ইনু বুয়েটে চলে যান এবং প্রকৌশল যন্ত্রপাতির সাহায্যে বৈজ্ঞানিকভাবে কত ইঞ্চি লম্বা, কত ইঞ্চি চওড়া, কোন জায়গায় মানচিত্র বসবে এসব ঠিক করেন।

এরপর ৪২ বলাকা ভবন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অফিসের পাশে পাক ফ্যাশন দর্জির দোকানে সেলাই করতে দেয়া হয়। ওখানে মোহাম্মদী নামে একজন অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে পতাকাটি তৈরি করেন। এরপর পতাকাটি ও একটা ছোট লাঠি সংগ্রহ করে ইনুর কক্ষে (শেরে বাংলা হল ৪০১, উত্তর) মুড়িয়ে রাখা হয়। পরদিন পল্টন ময়দানে জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজে পতাকা নিয়ে যাওয়া হয়। কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন আ স ম আব্দুর রব। রবই পতাকাটি বঙ্গবন্ধুর হাতে হস্তান্তর করেন। বঙ্গবন্ধু মোড়ানো পতাকাটি খুলে সবাইকে দেখান। পরে খোলা পতাকা নিয়ে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু অভিবাদন গ্রহণ করেন। ওইদিন কোনো ভাষণ ছিল না। কিন্তু জয়বাংলা বাহিনীর ওই পতাকা তিনি সাদরে গ্রহণ করেন এবং প্রদর্শন করেন। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু এই পতাকার প্রতি নৈতিক সমর্থন করলেন। 

জাতীয় পতাকার জন্মকথা এভাবেই তুলে ধরেছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা, সাবেক তথ্যমন্ত্রী, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। সত্তরের জুন মাসে পতাকা তৈরি হলেও আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন হয় একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণের বটতলায় সংগ্রামী ছাত্র সমাজের বিক্ষোভ সমাবেশে। সেদিন পতাকাটি নিয়ে মালিবাগের বাসায় রেখেছিলেন নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেন। ২ মার্চ একটি বাঁশের মাথায় ওই পতাকাটি বেঁধে রোকেয়া হলের দিক থেকে মঞ্চস্থলে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসেন। রব তখন সেই পতাকা তুলে ধরেন। শিবনারায়ণ দাশের তৈরি করা লাল-সবুজের ভেতরে হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্রসংবলিত ওই পতাকা ধরেই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয় বাংলাদেশ। শুধু স্বাধীনতার পতাকাই নয়, অস্ত্র হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন গেরিলা যোদ্ধা শিবনারায়ণ। বাবা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক সতীশচন্দ্র দাশ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। মুক্তিযুদ্ধে পিতা-পুত্র কারো কোনো স্বীকৃতি নেই। উইকিপিডিয়াতেও শিবনারায়ণকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার মূল ডিজাইনার হিসেবে। কিন্তু, বাস্তবিক অর্থে শিবনারায়ণ দাশ কতটুকু স্বীকৃতি পেয়েছেন? কজনই বা জানেন তার কথা? বিস্মৃত এই মানুষটিই যে আমাদের প্রাণের জাতীয় পতাকার ইতিহাসে জড়িয়ে!

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে মানচিত্রসংবলিত ওই লাল-সবুজ পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দিয়ে ডিজাইনার হিসেবে স্বীকৃতি পান শিল্পী কামরুল হাসান। আর মূল পতাকার ডিজাইন নিজে করেও তার স্বীকৃতি পাননি শিবনারায়ণ দাশ। আত্মাভিমানী শিবনারায়ণ হারিয়ে যান বিস্মৃতির আড়ালে। নিজের ক্ষোভের কথা কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেননি। বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টটা সব সময় নিজের ভেতরই চেপে রেখেছেন। কখনো গণমাধ্যমের সামনেও দেখা যায়নি তাকে। অভিমানী শিবনারায়ণ দাশ স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরী ও সন্তান অর্ণব আদিত্য দাশকে নিয়ে রাজধানীর মনিপুরীপাড়ায় বসবাস করছেন।

গতকাল বুধবার এই নিভৃতচারীর সঙ্গে কথা হয় গণমাধ্যামকর্মীর। বললেন, চারদিকে শুধু চাটুকার দেখি। সব নেতা, সব বড় বড় নেতা। মানুষ চেনা খুব কঠিন। মানুষ বোঝা খুব জটিল। কার কাছে চাইব? কী চাইব? আমার বলার কিছু নেই। সুকান্তর কবিতা পড়েছ? ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। আমার কাছে এখন সবকিছুই গদ্যময়। আমাকে নিয়ে লিখে কী হবে? শুধু শুধু পত্রিকার পাতা নষ্ট হবে।

এর আগে একবার প্রকাশ্যে এসেছিলেন অভিমানী শিবনারায়ণ। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কলাভবনের সামনে আয়োজিত ‘চতুর্থ জাতীয় পতাকা উৎসব-২০১৪’ এ উপস্থিত হয়েছিলেন পতাকা তৈরির মূল কারিগর। ওই সময়ও পতাকা নির্মাণের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে তার কণ্ঠে ঝরে পড়ছিল প্রচণ্ড অভিমান। বাংলাদেশের অমূল্য অর্জন জাতীয় পতাকা তৈরির ইতিহাস বলতে গিয়ে সেদিন বলেছিলেন, সবুজ রং দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছিল এই সবুজ বাংলার চিত্র, আর লাল রংটি দেয়া হয়েছিল সংগ্রাম এবং জীবনের প্রতীক হিসেবে। আর মাঝে মানচিত্রটি সোনালি রং দিয়ে আঁকা হয়েছিল এই সোনালি বাংলার প্রতীক হিসেবে। কারণ বাংলাকে সবাই তখন সোনার বাংলা হিসেবেই উল্লেখ করত। পতাকার মাঝে মানচিত্র আঁকার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন, পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলা আলাদা করে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বোঝাতে মানচিত্রটি দেয়া হয়, যাতে করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়। কারণ আমাদের বাংলা বলতে বুঝিয়েছি আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ডকে। পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ড অন্য একটি রাষ্ট্রের ভূখণ্ড। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত নয়। মানচিত্র সরানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, পতাকা সঠিকভাবে তুলে ধরা জাতির কর্তব্য। কিন্তু মানচিত্র থাকায় পতাকাটি আঁকা অনেক কঠিন এবং বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সহজ করে পতাকা আঁকার জন্য মানচিত্রটি সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

শারীরিক-মানসিকভাবে ভালো নেই শিবনারায়ণ। শ্বাসকষ্টের রোগী। ঘর থেকে বের হতে পারেন না। ধুলোবালি সহ্য হয় না। আর রয়েছে বুকে জমানো আত্মাভিমান। যা ঝরে পড়ছিল তার প্রতিটি কথায়, প্রতিটি বাক্যে। কারণ জাতি তার অবদানের কোনো মূল্যায়ন করেনি। তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি দেয়নি। তবুও দেশমাতৃকার প্রতি প্রেম, পতাকার প্রতি ভালোবাসা আজও অটুট তা বুঝিয়ে দিলেন একবাক্যে- ‘আমি প্রচারবিমুখ। নিভৃতে থাকতে ভালোবাসি। ঢাকঢোল পিটিয়ে কোনো কাজ করতে পছন্দ করি না। কদিন আর বাঁচব? শুধু একটাই চাওয়া পতাকা ভালো থাকুক। দেশ ভালো থাকুক।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ - dainik shiksha শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি - dainik shiksha ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0090641975402832