সময় যত বদলাচ্ছে, গবেষণায় বহুমাত্রিকতার বিষয়টি তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। গবেষণাকে এখন আর কোনো একটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না, বরং গবেষণার সুফল পেতে একটি গবেষণায় বিভিন্ন বিষয়ের সম্মিলন ঘটছে। বেশির ভাগ গবেষণার যাত্রা শুরু হয় কল্পনা থেকে। কল্পনা অনেকটা ছায়ার মতো, যেটার শারীরিক কোনো অস্তিত্ব থাকে না। রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, তবে কোথাও না কোথাও একটা সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কল্পনায় যখন চিন্তা যুক্ত হয়, গবেষণা তখন ছায়ার আবরণ ভেঙে বের হয়ে আসতে থাকে। তবে ছোট ছোট ভাবনা একটা অন্যটার সঙ্গে জোড়া লাগতে লাগতে চিন্তার পুরো ছবিটা তৈরি করে। ভাবনা যদি রংতুলির বিভিন্ন রং হয়, চিন্তা সে রং দিয়ে গড়ে ওঠা এক বিস্ময়কর চিত্রকর্ম। আর এই চিত্রকর্মের পেছনের চিত্রশিল্পীটাই হচ্ছেন গবেষক। একটা সময় ছিল যখন একজন মানুষের মধ্যেই বহুমাত্রিকতা জন্ম নিয়েছিল। সময় যত গড়িয়েছে বহুমাত্রিক প্রতিভার মানুষের সংখ্যা কমেছে। অথচ বিষয়টা উল্টো ঘটার কথা ছিল। হয়তো এখানটায় গবেষণার সুযোগ রয়েছে। তবে মানুষ থেমে থাকেনি। কোলাবরেটিভ রিসার্চের মাধ্যমে বিভিন্ন শাখার গবেষকরা তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা একীভূত করে নতুন নতুন গবেষণা করে যাচ্ছেন।
সাহিত্যের সঙ্গেও বিজ্ঞানের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সাহিত্য মানুষের মধ্যে কল্পনা তৈরি করে। মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যেসব গবেষক বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের চর্চা করেছেন, তাঁদের গবেষণা মৌলিকত্ব অর্জনে সক্ষম হয়েছে। সাহিত্যের কল্পনা গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয়েছে। যার যত কল্পনাশক্তি তৈরির সক্ষমতা, তার তত গবেষক হিসেবে সফলতা। কল্পনা, ভাবনা ও চিন্তার সমন্বিত চর্চার মাধ্যমে মানুষ তার সৃজনশীলতা ক্রমাগত বাড়াতে বাড়াতে সর্বোত্তম পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। প্রকৃতির মধ্যে গবেষণার নানা ধরনের উপাদান ছড়িয়ে আছে, যেগুলোর গবেষণালব্ধ ফলাফল আমাদের শিল্প-কারখানার রিসোর্স হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। এ ছাড়া প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত মূল্যবান কাঁচামাল রপ্তানিমুখী শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের ছোট ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাধান্য দিলে শিক্ষার মাধ্যমে যেমন মেধার বিকাশ ঘটবে, তেমনি শিক্ষায় আনন্দের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাও যুক্ত হবে। এ ধরনের শিক্ষার মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এই আনন্দ ও চিন্তাকে শিক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারব কি না। আমাদের গতানুগতিক শিক্ষায় ধারাবাহিকতা নেই, বরং এক ধরনের খাপছাড়া ভাব রয়েছে। আনন্দের চেয়ে অনাগ্রহের আধিপত্য রয়েছে। এর ফলে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থী বের করে আনা যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার ফল কখনো মেধা যাচাইয়ের মাধ্যম হতে পারে না, বরং এটি শিক্ষার অনেক উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান মাত্র।
গবেষণার মেধাকে বের করে আনার ক্ষেত্রে গবেষণাধর্মী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেটি শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা ও আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন শিক্ষার আনন্দ শিক্ষার্থীকে শিক্ষামনস্ক করে তোলে। শিক্ষা তখনই বিনিয়োগের পূর্ণ মাত্রা পাবে, যখন শিক্ষা থেকে অর্জিত গবেষণামনস্কতা শিক্ষার্থীকে মৌলিক ও ফলিত গবেষণার নতুন নতুন উপাদান আবিষ্কারে এবং প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধানে চিন্তাশক্তির প্রয়োগের উপযোগী করে গড়ে তুলবে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের শিল্প-কারখানায় গবেষণাক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলো মোকাবেলায় শিক্ষার্থীরা তাদের গবেষণালব্ধ চিন্তাধারা প্রয়োগ করবে। দেশের শিল্প-কারখানার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশের শিল্প-কারখানাগুলোর সঙ্গেও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে শিক্ষার সর্বজনীন বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে হবে। এভাবে শিক্ষা ও গবেষণাকে আন্তর্জাতিক বলয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।মৌলিক গবেষণা করার ক্ষেত্রে এখনো আমরা পিছিয়ে। এই জায়গায় উৎকর্ষ সাধনে শিক্ষাকে ব্যবহার করতে হবে। মৌলিক গবেষণায় শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে শিক্ষার প্রারম্ভিক সময় থেকে গবেষণার মৌলিকত্বের খুব সাধারণ ছোট ছোট ব্যাবহারিক উদাহরণ, সেগুলোর আনন্দপূর্ণ পরিবেশে প্রয়োগ ঘটাতে হবে। তবে সে ভাবনাগুলোকে বাস্তবমুখী করতে শিক্ষাকে দায়িত্ব নিতে হবে। এখানে শিক্ষা বলতে সামগ্রিক ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, আমরা একটা নতুন শিক্ষাপদ্ধতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যেখানে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা গড়ে তোলা হবে। পরীক্ষার চাপ কমিয়ে জীবনাচরণের বিষয়গুলো ও সৃজনশীলতা কিভাবে একটি আনন্দময় শিক্ষার জন্ম দিতে পারে, সেটি এখন দেখার বিষয়। একজন ভালো মানুষ তৈরি করা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ ভালো মানুষ ভালো চিন্তার জন্ম দেয়। আর সেই বিশুদ্ধ ও উদার চিন্তা থেকেই জন্ম নিতে পারে বড় বড় গবেষক।
নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে হবে। কারণ সবচেয়ে বড় সাহসের নাম স্বপ্ন দেখা। যে স্বপ্ন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নতুন প্রজন্ম দেখবে না, বরং স্বপ্ন বাস্তবায়নের অমিত সম্ভাবনা নিয়ে দেখবে। শিক্ষা ও গবেষণায় স্বপ্ন দেখানোর মতো শিক্ষক থাকতে হবে। স্বপ্ন দেখার মতো শিক্ষার্থীর জন্ম দিতে হবে। যারা আত্মহত্যাকে না বলবে, জীবনের জয়গানে মেতে উঠবে।
একটু আত্মসমালোচনার জায়গায় আসতে চাই। ব্রিটিশদের কেরানি বানানোর থিওরি এখনো আমাদের মধ্যে শক্ত শিকড় গেড়ে আছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় আমরা নতুন জ্ঞান সৃষ্টির চেয়ে কেরানিগিরি করাকে বেশি সম্মানজনক বলে মনে করছি। কারণ কেরানিগিরি করলে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া যায়, ছাত্রদের নিজ স্বার্থে ব্যবহার করা যায়, দল ভারী করা যায়, অন্যদিকে গবেষণা করলে অপমান, অবহেলা ও সন্দেহের মতো নেতিবাচক বোঝা মাথায় বয়ে বেড়াতে হয়। সারা পৃথিবীতে গবেষণা জ্ঞান সৃষ্টি ও আনন্দের মূল শক্তি হলেও আমাদের দেশে গবেষণা করাটা যেন মহাপাপ। নিজেও গবেষণা করব না আর অন্য কেউ গবেষণা করলে তাঁকেও কিভাবে থামিয়ে দেওয়া যায়, আমাদের মনোভাব অনেকটা সে ধরনের। যিনি কোনো একটি গবেষণার সমালোচনা করছেন, মূলত তিনি সমালোচনা করছেন নাকি অবমাননা করছেন, সে বিষয়টির বোধশক্তি তাঁর মধ্যে থাকা দরকার।
সময় বদলেছে, মানুষও বদলেছে। এখন ত্যাগের চেয়ে ভোগের মূল্য বেশি। ব্যক্তিত্বের চেয়ে তোষামোদির মূল্য বেশি। সম্প্রীতির চেয়ে কাদা ছোড়াছুড়ির মূল্য বেশি। পৃথিবীর সব স্তরের শিক্ষায় নতুন জ্ঞান সৃষ্টি একটি প্রধান উপাদান, যার পেছনে মূলশক্তি হিসেবে কাজ করছে গবেষণা। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টেক্সট বইয়ের বাইরে গিয়ে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির ধারণা ছাত্রদের মধ্যে গড়ে তুলতে কারো কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা নেই। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে তার ছিটেফোঁটাও নেই।
অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, এমআইটির মতো আমরা কি বদলে যেতে পারি না? কাউকে অনুকরণ নয়, অনুসরণ করে ইতিবাচক বিষয়গুলো নিতে তো কোনো দোষ নেই। তবে যা ইতিবাচক সেগুলোই মন ভরে নেব, নিজের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে নয়।
লেখক : ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরীঅধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর