ভাষা-সাহিত্যে কেনো এই স্থবিরতা

মাজহার মান্নান |

‘বিদ্যা, প্রজ্ঞায় বুক বাঁধে আশায় যেই জাতি সমৃদ্ধ সাহিত্য আর ভাষায়’। বাঙালি জাতির কাছে ঐতিহাসিক একটি মাস ফেব্রুয়ারি। এ মাসেই লড়াই করে, জীবন দিয়ে, রক্ত ঝরিয়ে বাঙালি জাতি তাদের মায়ের ভাষার অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষা করেছিলো। পৃথিবী নামক ভূখন্ডে একমাত্র বাঙালিরাই ভাষার জন্য লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। তাইতো বাংলা ভাষা আজ বিশ্ব দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। আমাদের ভাষা দিবসকে সারা বিশ্ব সম্মান দিয়েছে। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো এটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দিয়েছে। বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলা আর তাই এটি বিশ্বে চতুর্থ ভাষার খেতাবটি অর্জন করেছে। এই ভাষা আমাদের অহংকার। এটি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত।আবুল ফজল বলেছিলেন, ভাষা ও সাহিত্যকে অবলম্বন করেই সম্ভব হয় সব রকম উন্নতি আর প্রগতি। একটি দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ তাদের ভাষা ও সাহিত্য। আর এই ভাষা ও সাহিত্যের দৈন্য একটি জাতিকে ধীরে ধীরে পঙ্কিলতায় ডুবিয়ে দেয়।

ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি হলো, একটি দেশ ও জাতির দর্পন। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বড় হতে হলে চাই জাতীয় সাহিত্য, আর জাতীয় সাহিত্য পারে জাতীয় উন্নতি নিশ্চিত করতে। মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হলো ভাষা। বাংলা ভাষায় আমরা আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ইচ্ছা আর মনের ভাব ব্যক্ত করি। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে দারুন একটি সংবাদ হলো, নতুন বছরের ভাষার মাসের শুরুতেই উচ্চ আদালতের একটি রায় বাংলায় লেখা হয়েছে। এটা আমাদের বড় পাওয়া। বাংলা ভাষার বিকৃতি, অবমাননা এবং দূষণ রোধে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তবুও যেনো এটা থামছে না। সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে  বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সংবিধানের এই নির্দেশনা আমরা কতোটুকু পালন করছি? নিজেদের ভাষাকে যদি নিজেরাই শুদ্ধভাবে চর্চা না করি, তবে কে সেটা করে দেবে? শুদ্ধ বাংলা বলা ও লেখা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু এই কাজ করার দায় যাদের ওপর বেশি, তারা কী করছেন! শিক্ষিত মহলেও শুদ্ধ বাংলা চর্চার বড্ড অভাব লক্ষ্য করি। বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে বিদেশী ভাষার আগ্রাসনে। চীন, বিদেশী ভাষার আগ্রাসন রুখে দিতে শক্তিশালী আইন করেছে। আমাদের দেশেও আইন আছে। কিন্তু আমরা ক’জন সেই আইন মেনে চলি? বাংলাদেশে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪-তে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং দূষণ রোধে আদালতের রুল জারি হয়েছে। কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন আর জবাবদিহিতা তেমোন দৃশ্যমান নয়।

একটি দেশের ভাষা ও সাহিত্যের যথাযথ চর্চা না হলে সেটা দুর্বল হয়ে যায় এমন কী  সেটার বিলুপ্তি ঘটতে পারে। ভাষার বিলুপ্তির নজীর বিশ্বে অনেক আছে। ভাষার বিকৃতি, দূষণ, রুপান্তর, অপব্যবহারে ভাষার বিলুপ্তি ঘটে। এক সময় সংস্কৃত ভাষা দাপুটে ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হতো । কিন্তু আজ সেটাকে বিলুপ্তই বলা যায়। একটি দেশের ভাষার সঙ্গে সেই দেশের সাহিত্যের আত্মীক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। একটি শক্তিশালী ভাষা পারে একটি শক্তিশালী সাহিত্য উপহার দিতে। মার্কিন লেখক ইমারসন বলেছিলেন, ভাষা হলো, ইতিহাসের দলিল এবং কবিতার জীবাশ্ম। ভাষা সাহিত্যের প্রাণ। সাহিত্য তাই, যা একটি নান্দনিক ভাষার চয়ণে অসাধারন করে তুলে, মূর্তকে বিমূর্ত করে তোলে। সাধারন কিছু শব্দ চয়ণে অসাধারণ কিছু অভিব্যক্তি ঘটে থাকে। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। খ্রিষ্টীয় দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে চর্যাপদ রচিত হয়, যা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য ছিলো কাব্যপ্রধান। ইসলামী ধর্ম সাহিত্য, বাউল পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, রামায়ন, মহাভারত, নাথ সাহিত্য ছিলো এ যুগের অন্যতম নিদর্শন।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর বাংলা সাহিত্যে দুটি ধারা দৃশ্যমান হয়ে উঠে। ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাহিত্য ও কোলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য। তবে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গেছেন উভয় বাংলার কিংবদন্তি লেখকরা। উইলিয়াম শেকসপিয়ার, ক্রিস্টোফার মার্লো, জন মিল্টনসহ বিখ্যাত লেখকদের সৃষ্টিকর্ম যখোন সারা দুনিয়ায় ঝংকার তুললো তখন বাঙালি লেখকেরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। মৌলিক এবং নন্দিত সৃষ্টিকর্মে বাঙালি লেখকরাও মুন্সিয়ানা দেখালেন। তারা বিশ্বকে দেখিয়ে , বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের ওজন। ধ্রুপদী সাহিত্য রচনা করে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলে শোষকগোষ্ঠির কাঁপুনি ধরে যায়। অমর সৃষ্টির জন্য কবিগুরু নোবেল জিতে বিরল সম্মান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য বয়ে আনলেন। দুনিয়ার সাহিত্যবোদ্ধাদের একটি ধারণা হয়েছিলো যে, গ্রীক, ইংরেজ এবং ফরাসিরাই পারে মানসম্মত মহাকাব্য আর সনেট উপহার দিতে। কিন্তু তাদের সেই ভুল ধারণাকে ভেঙে দিলেন আমাদের মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মেঘনাথবধ মহাকাব্য রচনা করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেন। শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্যের অনেক মহীরুহকে আমরা দেখি যারা এখনও জীবন্ত হয়ে আছেন পাঠক হৃদয়ে। তাদের মধ্যে হরপ্রসাদশাস্ত্রী, ভারতচন্দ্র, রামাই পন্ডিত, চন্ডীদাস, মালাধর বসু, বিদ্যাপতি, কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাশ, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, শাহ মুহাম্মদ সগীর, দৌলত কাজি, ফকির গরীবুল্লা, আলাওল, লালন, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মধুসুদন দত্ত, মীর মোশারফ, জীবনানন্দ দাশ, সুকুমার রায়, অমিয় চক্রবর্তী, বদ্ধুদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, ফররুখ আহমেদ, সুফিয়া কামাল, আল মাহমুদ, শামসুর রহমান, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনসহ আরো অনেকে। এরা প্রত্যেকেই তাদের স্ব স্ব লেখনী দিয়ে বাংলা সাহিত্যে জাগরণ সৃষ্টি করেছেন। এনে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে স্বর্ণযুগের স্বাদ। একটি সাহিত্য কতো মধুর হতে পারে, কতো ডাইমেনসনাল হতে পারে, কতো মৌলিক হতে পারে-কতো সর্বজনীন হতে পারে, সেটা প্রমাণ করেছেন এসব কিংবদন্তি লেখকরা।কেউ জগতে বেঁচে থাকেন না। কিন্তু কারো সৃষ্টি কর্ম মরে না। তবে সেই সৃষ্টি কর্মকে হতে হয় কালজয়ী। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু বাংলা সাহিত্যে এক বড় শুন্যতার সৃষ্টি করেছে। গতবছর চলে গেলেন কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। আরো শুন্যতার সৃষ্টি হলো বাংলা সাহিত্যে। কবি নির্মলেন্দু গুণ এখনো বেঁচে আছেন। বয়সের ভারে তিনি আজ বড় ক্লান্ত। কিন্তু এর পরে কারা ধরবেন বাংলা সাহিত্যের হাল? কেউ কী এ বিষয়ে সত্যি ভাবেন? কেনো এখন বাংলা সাহিত্যে বড় কবি, উপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার তৈরি হচ্ছে না। দুর্বলতা তবে কোথায়? নজরুল, রবি ঠাকুরের কথা বাদ দিলাম। হুমায়ূন আহমেদ, শামসুর রাহমান, হাসান আজিজুল হকের মতো লেখকও কী দেশে আর তৈরি হবে না? আমাদের দৈন্যতা ঠিক কোথায়? এ বিষয়ে কি কোনো রাষ্ট্রীয় মাথাব্যথা আছে? সেটাতো মনে হয় না। কিংবদন্তি লেখকরা যেটুকু রেখে গেছেন সেটুকু যত্ন করে রাখতে পারবো তো আমরা? একটি সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন শাখা আছে। সেগুলোর মধ্যে কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, গান, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদি। বর্তমানে কবিতার অবস্থা তো খুবই নাজুক। নাটকের অবস্থাও লেজেগোবরে। কোথায় গেলো সেই নাটকের মান? কোথায় গেলো নাটকের সেই শুদ্ধ ভাষা আর কাহিনীর মাধুর্যতা? কোথায় গেলো প্রাণজুড়ানো সেই সুরেলা গান? কোথায় গেলো সেই শিশুতোষ ছড়া? কোথায় গেলো আজ সেই অনুবাদ আর তুলনামূলক সাহিত্যের গবেষণা?

সাহিত্যের অতি পুরাতন এবং অভিজাত শাখা হচ্ছে, কাব্য। গ্রীক দার্শনিক এ্যারিষ্টিটল কাব্যকে সমাজ বদলের এক বড় হাতিয়ার হিসাবে বিবেচনা করেছেন। কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুধু সাহিত্য নয়, ইতিহাসের এক অনন্য সম্পদ।একটি কবিতা একজন কবির জীবন খেয়ে বেঁচে থাকে। একটি কবিতার প্রতীকধর্মীতা, বিষয়ের গভীরতা, বিষয়ব্যঞ্জনা, শিল্প প্রকরণ, নান্দনিকতা, সাহিত্য রস একটি কবিতাকে অমর করে রাখে। একটি ভালো কবিতা বহু সময় ধরে পাঠকের মননশীল মানসিকতা তৈরিতে অবদান রাখে। এক সময় তরুণরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমানের কাব্যের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তরুণদের সেই আগ্রহে ভাটা পড়ছে।

সাহিত্যের একটি ধ্রুপদী মাধ্যম কবিতা। সাহিত্যের পাঠক মানেই কবিতা পাঠক নন। একুশে বইমেলায় কবিতার বই বিক্রির হার উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। প্রচুর কবিতার বই তৈরি হচ্ছে, কিন্তু পাঠক সমাদর মিলছে না। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে কবিতা টনিক হিসাবে কাজ করে।  তবে সে কবিতা যদি পাঠক হৃদয়ে নাড়া দিতে না পারে, তবে তা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।  তরুণ শিক্ষিতদের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণি থাকে, যারা কাব্য ভালোবাসেন। কিন্তু সেই শ্রেণিও এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।কেননা তাদের মনপোযোগী কাব্যের আজ বড় আকাল। প্রখ্যাত কবিদের বাইরেও বহু কাব্য রচিত হয়। কিন্তু পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে সেসব হারিয়ে যায়। এ দায় কী শুধু কবির বা পাঠকের? রাষ্ট্রেরও এক্ষেত্রে কিছু দায় আছে। কাব্যশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বড় প্রয়োজন। অনেক ভালো কবিতা আছে যেগুলো পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে আলোর মুখ দেখে না। আজ তরুণ প্রজন্মের হাতে মাদক উঠেছে, অথচ তাদের হাতে কাব্যের বই শোভা পাওয়ার কথা। একটি কবিতার বই একজন তরুণের মাঝে জীবনবোধ, পরিমিতিবোধ, দায়িত্ববোধ, ও সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করে। কিন্তু কেনো তাদের হাতে কাব্যের বই ওঠে না? এটা কী শুধু তাদের দায়, নাকি রাষ্ট্রেরও কোনো দায় আছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কাব্য সম্মেলন তেমন একটা চোখে পড়ে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেটুকু হচ্ছে তা দিয়ে কাব্যের বিস্তার সম্ভব নয়। বর্তমানেও অনেক নাম না জানা কবি নান্দনিক কবিতা লিখছেন। তাদের এই লেখা যদি পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই করে দেয়া যায়-তবে তারা আরও উৎসাহিত হবেন, আরও সৃষ্টিশীল কাব্য তৈরি হবে। তরুণ প্রজন্মকেও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। বাবা-মায়ের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে মাদক না কিনে একটি কবিতার বই কিনলে সে নিজেও উপকৃত হবে এবং সমৃদ্ধ হবে কাব্যশিল্প। ১০০/২০০ টাকায় একটি কবিতার বই কেনা যায়। অভিভাবকরা যদি তাদের সন্তানদেরকে বই কিনে দেন তবে তারা বিপথগামী হবেন না। অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, কবিতা একজন তরুণের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলে এবং মার্জিত রুচিবোধ তৈরি করে।
                    
আধুনিক কবিতা পড়ে কিশোর আর তরুণরা  কোনো মর্মার্থ খুঁজে পান না, কোনো ছন্দ খুঁজে পান না। কবিতার ভাষা তারা বুঝেন না। তাদের আনন্দ না পাওয়ার পেছনের কারণ হলো ১. মানহীন লেখা। ২. ভাষার জটিলতা ৩. ছন্দের অভাব ৪. সঠিক মাত্রা বিন্যাসের অভাব ৫. অন্তঃসারশূন্য বিষয়বস্তু ৭. লেখার মান যাচাই না করেই নির্বিচারে কবিতার বই ছাপানো ৮. মিডিয়া কাভারেজ কাঙ্খিত পর্যায়ে না পাওয়া ৯. যেনো-তেনো লিখে বড় কবি হওয়ার বাসনা ১০. লেখার মৌলিকত্বের দিকে নজর না দেয়া ১১. কাব্য আন্দোলন তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া ১২. যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাব্য রচনা করতে না পারা।
১৩. কবিতা পড়া নয়, শুধু লিখে কবি পরিচিতি নেয়ার বাসনা। ১৪. ছাপানো সব বই সৌজন্য দিয়ে নিজেকে কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ চেষ্টা ১৫. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবিতা লিখে রাতারাতি কবি হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।  William Wordsworth রোমান্টিক যুগের শুরু করলেন, যা  সাহিত্যের এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিলো। তার মূল কথা ছিলো, কাব্যিক ভাষা হবে সহজ,সরল। যেনো সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারেন। তাল নেই, লয় নেই, ভাষার মাধুর্য নেই, সারসত্তা নেই..এমোন কাব্য কেউ রচনা করলে তা কাব্য হয়ে উঠবে না। যে কাব্য পাঠক হৃদয়ে নাড়া দিতে পারে না, সে কাব্য মানুষ বর্জন করে। আজ কাব্য জগতে খরা চলছে।


কিছু সাংবাদিক লেখক হওয়াতে তারা সহজে মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছেন। পাঠ্য বইতে কারও একটি কবিতা যুক্ত হলে তো কথাই নেই। দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোরও কিছু দায়িত্ব আছে এক্ষেত্রে। অনেক ভালো মানের লেখা চাপা পড়ে যায়, অথচ শক্ত যোগাযোগের কারণে অনেক সময় মানহীন লেখাও ছাপা হয়ে যায়। ফেসবুকে কাব্য চর্চার একটি অবাধ ক্ষেত্র। কিন্তু সেখানে লেখার মৌলিকত্ব দেখার কেউ নেই। যে যার মতো করে লিখে যাচ্ছেন। সবাই সস্তা এবং দ্রুত জনপ্রিয়তার পেছনে অবিরাম ছুটে চলছে। যে সব প্রতিষ্ঠান সাহিত্যের সেবা করে তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। যোগ্য লেখাকে পুরস্কৃত করা ও লেখককে সম্মান দেয়া তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমার নগন্য জ্ঞানে এতটুকু বুঝি যে, মানসম্মত ও মৌলিক লেখা উপহার দিলে পাঠক সেটা লুফে নেবে। পাঠকদেরকে এত বোকা ভাবার কোন কারণ নেই।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক বাংলা একাডেমীর দায় অনেক বেশি। বছরে কয়েকটি পুরস্কার দিয়ে দিলেই বড় লেখক তৈরি হবে না। বাংলা একাডেমীকে লেখক তৈরির সুযোগ করে দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সাহিত্য সম্মেলনের বড় অভাব। আগে রাজ কবির প্রচলন ছিলো। রাজপ্রাসাদে কবি, লেখক থাকতেন।এর ফলে লেখকরা সরাসরি অনুপ্রেরণা পেতেন। আজ সেটাও নেই। লেখকরা মনে হচ্ছে বড় এতিম হয়ে পড়ছেন। কলম চালানোর ক্ষেত্রেও লেখকরা অনেকটা ভয়ে থাকেন। আইসিটি আইনের ঝামেলায় পড়তে পারেন..ভেবে অনেকে লেখেন না। কিন্তু ভয় করে তো আর লেখক হওয়া যায় না। অন লাইন সাহিত্য সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্ বন্ধ করা উচিত। এরা সাহিত্যের মান নষ্ট করছে। পাঠকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য  হারে হ্রাস পেয়েছে। তারা আজ আর ছাপা বই, পত্রিকা পড়তে চান না। এ দায় কী শুধু পাঠকের? রাষ্ট্রের কী দায় নেই? প্রযুক্তি বিপ্লব কী তবে সাহিত্যচর্চার গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে?  বঙ্গবন্ধু কবি, সাহিত্যিক আর লেখকদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি কাজী নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছেন। তার নির্দেশে  বাংলা একাডেমী চালু হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা লেখকদের জন্য ভালো কিছু করবেন এটা আশা করতেই পারি। আজ পর্যন্ত একটি ‘কবিভবন’ তৈরি হলো না। ঢাকা শহরে কতো কিছু হলো, কিন্তু কবিভবন হলো না। আমি কবিভবনের দাবিতে কিছুটা সোচ্চার ছিলাম। কিন্তু আমার মতো নগন্য ব্যক্তির কথা কে শোনে! এখনও অনেক সাহিত্যকর্ম তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কেন সেসব সাড়া জাগাতে পারছে না? আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারছে না। দায় কার? পাঠক, লেখক না রাষ্ট্রের? আজ আমাদের সংস্কৃতির মরণদশা শুরু হয়েছে। যুগোপযোগী সাহিত্য তৈরি না হলে সংস্কৃতিও বাঁচবে না। বইপড়া আন্দোলনকে কেনো চাঙ্গা করা যাচ্ছে না? শুধু বছরে একটি বই মেলা করে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা যাবে না। একটি সাহিত্য কমিশন গঠন করা যেতে পারে। সাহিত্য কমিশন শব্দটি অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু আজ এর আর কোন বিকল্প নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে কবি-সাহিত্যিকদের বই ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলা একাডেমী বছরে একবার পত্রিকায় সার্কুলার দিয়ে লেখা আহবান করতে পারে। যে লেখাগুলো জমা হবে সেগুলোর একটি যাচাই কমিটি থাকবে। ভালো লেখাকে পাঠ্যবইয়ে  ঠাঁই করে দিতে হবে। জাতীয় পত্রিকাগুলোও সেগুলো ছাপানোর উদ্যোগ নিতে পারে। বিচ্ছিন্নভাবে সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম অনেক ক্ষেত্রেই আলোর মুখ দেখে না। তাই প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হবে রাষ্ট্র।
  সারা বাংলার লেখক-কবি, কলম চলুক জোরে
  সাহিত্য বেঁচে থাকুক যুগ,জনম ধরে।

লেখক : মাজহার মান্নান, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026040077209473