ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর জন্মদিন আজ।  তিনি ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মফিজউদ্দীন আহমদ ছিলেন পীর গোরাচাঁদের দরগাহর খাদেম। পৈতৃক পেশা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন।

তিনি ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে উর্দু, ফারসি ও আরবি শেখেন এবং স্কুলে সংস্কৃত পড়েন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পাস করার পর তিনি হুগলি কলেজে পড়াশোনা করেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে অধ্যয়নে সাময়িক বিরতির পর তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এমএ পাস করেন। দুবছর পর তিনি বিএল ডিগ্রিও অর্জন করেন।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন; তারপর সীতাকুন্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার পর তিনি চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাটে আইন ব্যবসায়ে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে শরৎচন্দ্র লাহিড়ী গবেষণা-সহকারী হিসেবে কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা তার জীবনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এখানে শিক্ষাদান কালে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা করেন এবং ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রমাণ করেন যে, গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে শহীদুল্লাহ্ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ যান। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বৈদিক ভাষা, বৌদ্ধ সংস্কৃত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, তিব্বতি ও প্রাচীন পারসিক ভাষা এবং জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন খোতনি, প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা শেখেন। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাও লাভ করেন এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। অতঃপর সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ ভেঙ্গে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ হলে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হন এবং ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খন্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫-৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস নিযু্ক্ত হন।
অধ্যাপনার বাইরে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ করাচির উর্দু& উন্নয়ন সংস্থার ‘উর্দু অভিধান প্রকল্প’, ঢাকার বাংলা একাডেমির ‘পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ এবং ‘ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্প’-এ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক, ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্ট, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য, ইসলামিক একাডেমির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলা একাডেমির বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন।
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে শহীদুল্লাহ্ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনিই প্রথম উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবি জানান। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন, ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন, কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম যুবক সম্মেলন, হায়দ্রাবাদে নিখিল ভারত প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন (ভাষাতত্ত্ব শাখা, ১৯৪১) এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। মাদ্রাজে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন ট্রাডিশনাল কালচার ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া’ অনুষ্ঠানে তিনি ইউনেস্কোর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তার চেয়ারম্যান মনোনীত হন।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস রচনাসহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহু জটিল সমস্যার সমাধান করেন। বাংলা লোকসাহিত্যের প্রতিও তিনি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। গবেষণাগ্রন্থের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য এবং শিশুসাহিত্যের অনেক মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ ও সম্পাদনাও করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: সিন্দবাদ সওদাগরের গল্প, ভাষা ও সাহিত্য, বাঙ্গালা ব্যাকরণ, দীওয়ান-ই-হাফিজ, শিকওয়াহ ও জওয়াব-ই-শিকওয়াহ, রুবাইয়াত-ই-উমর খয়্যাম, আমাদের সমস্যা, পদ্মাবতী, ইত্যাদি। তার সম্পাদিত আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এক বিশেষ কীর্তি। মুহম্মদ আবদুল হাই -এর সঙ্গে তার যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত Traditional Culture in East Pakistan একখানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তার Buddhist Mystic Songs গ্রন্থটি চর্যাপদের অনুবাদ ও সম্পাদনা কর্ম। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে চর্যাপদ সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় রচিত; এর ধর্মতত্ত্ব নিয়েও তিনি আলোচনা করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন বহুভাষাবিদ এবং ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। তিনি ১৮টি ভাষা জানতেন; ফলে বিভিন্ন ভাষায় সংরক্ষিত জ্ঞানভান্ডারে তিনি সহজেই প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। 
জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’, ফরাসি সরকার কর্তৃক ‘নাইট অব দি অর্ডারস অব আর্ট লেটার্স’ উপাধিতে ভূষিত হন। ‘জ্ঞানতাপস’ হিসেবে পরিচিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুলাই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ হল চত্বরে তাকে সমাহিত করা হয়। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ - dainik shiksha ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস - dainik shiksha এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026161670684814