ভাড়া দিতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বাঁকা কথার শিকার

নিজস্ব প্রতিবেদক |

নজরুল ইসলাম তাঁর স্কুলপড়ুয়া শিশুসন্তানকে নিয়ে আরশীনগর থেকে জিগাতলা যাচ্ছিলেন। শিশুর পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম। এ পথের ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা। নাসিমুল ২০ টাকার দুটি নোট বাড়িয়ে দিতে তা পকেটে পুরে চলে যাচ্ছিলেন চালকের সহকারী।

শিশুর অর্ধেক ভাড়া কেন রাখা হচ্ছে না, নাসিমুলের এমন প্রশ্নে ৫ টাকা ফেরত দেন চালকের সহকারী। কিছুক্ষণ পর নাসিমুল বলেন, ‘১৫ টাকা কেন রাখলেন, ১০ টাকা রাখেন।’ চালকের সহকারী পাঁচ টাকা ফেরত দিলেন বটে, সঙ্গে দু-এক কথা শুনিয়েও দিলেন। চালকের সহকারী বলেন, ‘অল্প ভাড়ায়ও অর্ধেক রাখতে হয়? এই নেন পাঁচ টাকা।’

বাসে হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) চালুসহ আরও বেশ কিছু দাবিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা দুই সপ্তাহ ধরে রাস্তায়। এর মধ্যে গতকাল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ অর্ধেক ভাড়ার দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য এর আগেই রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি অর্ধেক ভাড়ায় ছাত্রছাত্রীদের পরিবহন করবে বলে আগেই জানিয়েছিলেন।

আজ বুধবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়ায় ছাত্রছাত্রীরা যাতায়াত করতে পারছে কি না, খোঁজ নিতে বিভিন্ন রুটের বাসের খোঁজখবর নিয়ে দেখা যা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাসে হাফ ভাড়া দিতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বাঁকা কথার শিকার হয়েছেন। বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে দু-এক জায়গায়। এমনকি বিআরটিসির একটি বাসেও ৪০ টাকার অর্ধেক হিসেবে এক ছাত্রের কাছ থেকে ৩০ টাকা নিতে দেখা গেছে।

দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন শেওড়াপাড়া থেকে আয়াত পরিবহনে মিরপুর–১ নম্বরে ঢাকা কমার্স কলেজে আসেন। সে বলে, ‘যেটা কার্যকর হয়েছে সেটা নেয়নি। শেওড়াপাড়া থেকে মিরপুর ১-এ আসতে ভাড়া ১০ টাকা। আজও আমার কাছ থেকে ১০ টাকাই রেখেছে। ইউনিফর্ম ছিল, আইডি কার্ডও ঝোলানো ছিল। তারপরও পুরো ভাড়া রেখেছে।’

পরিস্থান পরিবহনের একটি বাসে মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর-১–এ যাচ্ছিল মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আবু বক্কর। বাসে টাঙানো চার্ট অনুসারে এই দূরত্বের ভাড়া ১৮ টাকা। কিন্তু আবু বক্কর ২০ টাকার নোট দিলে চালকের সহকারী মো. শামীম আরও ৫ টাকা চান। তাঁর দাবি, ওয়েবিলের হিসাবে ভাড়া ২৫ টাকা।

এমনকি ওয়েবিলের সময় আবু বক্কর জানায়, সে শিক্ষার্থী। কিন্তু ভাড়া নেওয়ার সময় শিক্ষার্থী পরিচয় দিলে, চালকের সহকারী বলেন, আবু বক্করের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেওয়ার কথা তিনি শুনতে পাননি। তারপর মোট ১৫ টাকা ভাড়া রাখেন।

বাসের ভেতর ঝোলানো চার্ট অনুযায়ী মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর-১–এর ভাড়া ১৮ টাকা। সেই হিসাবে অর্ধেক ভাড়া ৯ টাকা। কেন ১৫ টাকা নেওয়া হলো? জানতে চাইলে চালকের সহকারী বলেন, ওয়েবিলের হিসেবে ১৩ টাকা আসে, তিনি ১৫ টাকা রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘হাফ পাস মানে পুরোপুরি হাফ তো না। খুচরার কারণে কিছুটা কমবেশি রাখি। আর এই বাসে আসাদগেট চেক পার হলেই ভাড়া ২৫ টাকা।’

বিআরটিসি বাসে ৪০ টাকার হাফ ৩০ টাকা

সাভারের টঙ্গী বাজার থেকে রাজধানীর কাকরাইলে যাচ্ছিলেন উত্তরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী শান্ত সূত্রধর। উঠেছেন বিআরটিসি বাসে। তিনি বলেন, এমনি ভাড়া ৪০ টাকা। আমি ছাত্র বলে আমার থেকে ৩০ টাকা রেখেছে। কেন বাড়তি ১০ টাকা রাখা হলো জানতে চাইলে চালকের সহকারী তাঁকে বলেছেন, ‘এটাই হাফ ভাড়া।’

কেন ১০ টাকা বেশি রাখা হলো জানতে চাইলে বাসচালকের সহকারী আবদুর রাজ্জাক বলেন, তাঁরা সব সময় ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেন। শান্তর কাছে অতিরিক্ত ভাড়ার নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শান্তকে ১০ টাকা ফেরত দেন।

অতিরিক্ত ভাড়া দেওয়ার অভিজ্ঞতা শুধু শান্তর নয়। রাজধানীতে চলাচল করা বিটিআরটিসিসহ বেসরকারি পরিবহনে চলাচল করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মো. সিয়াম ফার্মগেট থেকে শাহবাগ যাচ্ছিলেন। বিআরটিসি বাসে ওঠার সময় সিয়ামকে আগেই বাসচালকের সহকারী বলেন, ‘১০ টাকার নিচে ভাড়া নাই।’ বাসে বসে সিয়াম এ প্রতিবেদককে বলেন, পাঁচ টাকা ভাংতি নিয়ে বাসে চলি। তা না হলে বেশি ভাড়া নেয়।’

নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় যাতায়াত করে ঠিকানা পরিবহন। আজ সকালে এই বাসে নারায়ণগঞ্জ থেকে উঠেছিলেন ইডেন কলেজের বেশ কয়েকজন ছাত্রী। তাঁরা জানান, আজ তাঁরা কিছুটা কম ভাড়ায় আসতে পেরেছেন। বাসে ৩০ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা লেগেছে। বাসচালকের সহকারী মো. হৃদয় অবশ্য দাবি করেন, তিনি ১৫ টাকা নিয়েছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী পুষ্পিতা, তেজগাঁও কলেজের ছাত্র রাশেদকেও অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হয়েছে। রাশেদ বলল, ‘কন্ডাক্টররা তর্ক করে। তাই ছাত্রের পরিচয় দিতে মন চায় না।’

অবশ্য বাসচালকের সহকারী নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিচ্ছেন। কিন্তু হাফ ভাড়ার বিষয়ে তাঁরা কোনো নির্দেশনা এখনো পাননি। শিখর পরিবহনের ব্যানারের একজন পরিবহন মালিক হাসান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘মালিকেরা সরকারি সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য। কেউ না মানলে যাত্রীদের ট্রাফিক পুলিশকে অভিযোগ করতে বলেন।’

বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ

ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে যাঁরা প্রতিদিন ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসেন, তাঁরাও আজ বিপত্তিতে পড়েছেন।

ঢাকা কমার্স কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, হাফ ভাড়া ইস্যুতে কিরণমালা পরিবহন থেকে আজ তাঁদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ছাত্রদের একজন সাব্বির হোসেন। তিনি প্রতিদিন কিরণমালায় গাজীপুরের কাশিমপুর থেকে মিরপুর-১–এর কলেজে যাতায়াত করেন। 

সাব্বির বলেন, ‘আমার কাছ থেকে আজ ভাড়া নিয়েছে ৪৫ টাকা। কলেজ পর্যন্ত আসতে চারবার চেক পড়ে। এক চেকের ভাড়া কম রাখে ছাত্রদের জন্য। যখন অর্ধেক ভাড়ার কথা বলেছি, তখন তর্ক করেছে। তর্ক করে মিরপুর ১০-এর সনি সিনেমা হল মোড়ে এসে আমাদের বাস থেকে নামিয়ে চেকাররা মারমুখী ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন। পরে এক আঙ্কেল এসে আমাদের সেখান থেকে তাঁদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন।’

তিনি বলেন, ‘চেকাররা বলছিল আমরা নাকি তর্ক করলে যাত্রীদের বিরক্ত করি। একজন বলেছে মারধর করলে কিছুই হবে না তার।’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে কিরণমালা পরিবহনের পরিচালকদের একজনের সঙ্গে দেখা হয় মিরপুর ১ চিড়িয়াখানা এলাকার ডিপোতে। তিনি বলেন, কাশিমপুর থেকে চার্টের ভাড়া ৬৯ টাকা। আগে এক চেকের ভাড়া ছাড় দেওয়া হতো শিক্ষার্থীদের জন্য।

মিরপুর ১-এ নামিয়ে দেওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঝামেলা এড়াতে নেমে যেতে বলা হয়। নামিয়ে চেকাররা বোঝানোর চেষ্টা করেন। আমরা বিষয়টা দেখব। যাত্রীদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করলে আমরা ব্যবস্থা নেই। কিন্তু প্রতি চেকে এলে নজর রাখা সম্ভব না। আসলে পরিবহনে যারা কাজ করে, তাদের ৮৫ ভাগই শিক্ষিত না। সে জন্য মাঝেমধ্যে এমন ঘটনা ঘটে যায়।’

আজ থেকে অর্ধেক ভাড়া কার্যকরের বিষয়টি নজরে আনলে তিনি বলেন, ‘আর ঘোষণাটা গতকাল বিকেলের দিকে এসেছে। রাতারাতি এলেও সব স্টাফকে জানানো সম্ভব হয়নি। ২ থেকে ১ দিন লেগে যাবে সবাইকে জানাতে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031030178070068