ভিসা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিড়ম্বনায় হাজারো জার্মানিগামী শিক্ষার্থী

নিজস্ব প্রতিবেদক |

ইউরোপের দেশ জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের শুরুতে ভর্তি হন বাংলাদেশের শিক্ষার্থী রায়হানুল ইসলাম। তিনি ভিসার জন্য ঢাকার জার্মান দূতাবাসে আবেদন করেন গত বছর সেপ্টেম্বরে। এরই মধ্যে ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও দূতাবাস থেকে তার ডাক আসেনি। এমন পরিস্থিতিতে নিজের শিক্ষাজীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটেছে রায়হানুলের। তিনি বলেন, ‘জার্মানির শিক্ষাপদ্ধতি অত্যন্ত কঠিন। অধিকাংশ ক্লাসই প্র্যাকটিক্যাল করতে হয়। অনলাইনে শুধু থিওরি ক্লাস করতে পারছি। আমার সঙ্গে যারা ভর্তি হয়েছে তারা সবাই জার্মানিতে গেলেও আমি যেতে পারছি না। এতে আমি তাদের থেকে অনেক পিছিয়ে গেছি। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে অনলাইনে সবকিছু বোঝাও সম্ভব হয় না। এতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে খারাপ বার্তা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।’ 

রায়হানুল একাই নন, একইভাবে বাংলাদেশ থেকে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আরও অনেক শিক্ষার্থীর বিড়ম্বনা যেন কাটছেই না। সরকারের দ্বারে দ্বারে ঘুরে মন নরমের ব্যবস্থা হয়েছিল বাংলাদেশে অবস্থিত জার্মান দূতাবাসের। কিন্তু ভিসা কার্যক্রম শুরুর এক মাস না যেতেই ফের বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দেশটিতে পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আবারও অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। তাদের আশঙ্কা, আসছে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সশরীরে ক্লাসে অংশ না নিতে পারলে ছাত্রত্ব বাতিল হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে জার্মান দূতাবাসকে ভিসা কার্যক্রম চালুর জন্য চাপ দিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

তারা জানিয়েছেন, দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পরপরই বাংলাদেশের জার্মান দূতাবাসে ভিসা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এরপর দূতাবাসে গিয়ে দফায় দফায় ধারণা দিতে থাকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি দিলে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে গত ১৭ মে থেকে শিক্ষার্থীদের ভিসা কার্যক্রম শুরু করে জার্মান দূতাবাস। কিন্তু এর মাত্র এক মাসের মাথায় গত মধ্য জুনে কর্মী সংকটের কথা উল্লেখ করে ফের এ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। জার্মান দূতাবাসের ওয়েবসাইটে ঢুকে শিক্ষার্থীদের ভিসা কার্যক্রম বন্ধ থাকার বিজ্ঞপ্তিতে ঝুলতে দেখা গেছে।

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধ চলাকালীন ভিসাসংক্রান্ত কার্যক্রমকে বিশেষ সেবার আওতায় এনে সব দূতাবাস খোলা রাখার কথা জানায় সরকার। এ সময় বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে দ্রুত টিকার ব্যবস্থাও করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ জুলাই পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী টিকা পেতে আবেদন করেন। যার বড় অংশটি চীনগামী শিক্ষার্থী। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চীন, যুক্তরাজ্য, ভারত ও কানাডাগামী শিক্ষার্থীরা ভিসা পেলেও আটকে আছে জার্মানিগামী শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম। এ বিষয়ে ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমউদ্দিন  বলেন, ‘সরকার বলছে দূতাবাস চালু থাকবে। কিন্তু আমরা দূতাবাসে ফোন করে জানতে পারছি লকডাউনের কারণে বাংলাদেশি কর্মীরা অফিস করছেন না। কিন্তু অন্যান্য জার্মানকর্মী অফিস করছেন। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অক্টোবর থেকে সরাসরি ক্লাস চালু করবে। এ সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। নইলে ছাত্রত্ব বাতিল হবে।’

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে জার্মান দূতাবাসের একটি ফোন নম্বরে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে যখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তারা বলেছেন এখনো ক্যাম্পাস, ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরি সব বন্ধ। সেখানে থাকার জায়গা নেই। অনলাইনেই ক্লাস হচ্ছে। যখন ফিজিক্যালি ক্লাস চালু হবে তখন তারা ভিসা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যেন আগেই আবাসনের জন্য টাকা পরিশোধ করে না দেয়, যারা টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে তারা বেশি হতাশায় পড়ছে।’

জানা গেছে, গত এক বছরে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছেন। তারা তিনটি সেমিস্টার অনলাইনে ক্লাস করছেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ব্লক অ্যাকাউন্টে ১১ লাখ টাকা করে জমা রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে অনেকেই কয়েক লাখ টাকা করে টিউশন ফি জমা দিয়েছেন। এ অবস্থায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। অনেকের ধারণা, তারা যেতেই পারবেন না। আবার অভিভাবকদের চাপেও শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন।

জার্মানিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা জানান, দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা থিওরি, প্র্যাকটিক্যাল ও ইন্টার্নশিপের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওরি ক্লাস অনলাইনে পরিচালিত হলেও প্র্যাকটিক্যাল ও ইন্টার্নশিপ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত থেকে ইন্টার্নশিপে অংশগ্রহণ করতে হয়। শুধু থিওরি ক্লাসে অংশ নিয়ে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ নেই। এ কারণে অনলাইনে ক্লাসরত শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ বিষয়ের ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না।

বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের খবর অনুযায়ী, শুধু বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাই এ জটিলতায় পড়েনি। জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দেশটিতে যেতে না পারায় বিড়ম্বনায় আছেন ভারত, তুরস্ক, ইরান ও নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে অনেকেই জার্মানি যাওয়ার কথা ভেবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে ভিসা পাওয়ার জন্য নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য প্রমাণে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার ইউরো জমা করেছেন। গত বছর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ‘এডুকেশন ইজ নট ট্যুরিজম’ (শিক্ষা পর্যটন নয়)-অনলাইনে এ নামে একটি হ্যাশট্যাগ চালু করেছেন। যার মাধ্যমে দূতাবাস, জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে তারা ভিসার ব্যাপারে ব্যাখ্যা দাবি করেছিলেন।

তখন জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ভিসা আবেদন ও ইস্যু করার বিষয়টি স্থানীয় করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। যেসব দেশে করোনা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে সেখানে দূতাবাসের কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা যাতে ভিসা পায় সেটি নিশ্চিত করতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলেও জানানো হয়েছিল।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032680034637451