ভুঁইফোড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিয়মের দায় কার

গুরুদাস ঢালী, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

গুরুদাস ঢালী, দৈনিক শিক্ষাডটকম: এ বছর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় সারা দেশে ২৯ হাজার ৮৬১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেন। পরীক্ষায় শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করেছেন ২ হাজার ৯৬৮ প্রতিষ্ঠানে। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, ৫১টি প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেননি। এর মধ্যে ঢাকা বোর্ডে ৩টি, রাজশাহী বোর্ডে ২টি, দিনাজপুর বোর্ডে ৪টি, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে ৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত বছর ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেননি, এবার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫১টি।

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি এদের মধ্যে অন্যতম, এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেননি কোনো শিক্ষার্থী। ১২ শিক্ষকের এই বিদ্যালয় থেকে মাত্র দুজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তারাও অকৃতকার্য হয়েছেন। এখানে ছাত্রীর সংখ্যা ২ শতাধিক। এর মধ্যে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন দুজন।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করলেও এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধানসহ ১২ জন শিক্ষক এবং তিন জন কর্মচারী রয়েছেন। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এটি একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি থাকলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা জানে না শিক্ষা অফিস।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। হঠাৎ কোনো সময় দু’একজন শিক্ষক-কর্মচারী আসলেও কোনো ছাত্রছাত্রীকে প্রতিষ্ঠানে আসতে দেখা যায় না।

অকৃতকার্য হওয়া ২ ছাত্রী জানায়, স্যাররা বিদ্যালয়ে আসেন না। বিদ্যালয়ে বসার চেয়ার-টেবিল নেই। পরীক্ষার আগে ফরম পূরণ করে আমাদের জানানো হয়, এসএসসি পরীক্ষা দিতে হবে। একপ্রকার বাধ্য হয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। আসলে পরীক্ষা দেয়ার মতো আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিলো না।

বিদ্যালয় এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, এখানে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। শিক্ষার্থীদের কখনো আমার চোখে পড়েনি। তবে মাঝেমধ্যে কয়েকজন শিক্ষককে আসতে দেখি। মাসের বেশিরভাগ দিন বন্ধই থাকে। কারণ, শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। আশপাশের ও আমাদের ছেলেমেয়েরা অন্য বিদ্যালয়ে পড়েন।

টানা ২ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে আসছে। পাঠদানের অনুমতি সাপেক্ষে দেখভালের দায়িত্ব বর্তায় কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার কারণে আজকের এই করুন পরিণতি। সবদায় শিক্ষক আর কমিটির দিলে আমাদের থাকার কোনো দরকার নেই। ২৪টি বছর কেউ কি মনে করেননি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের সব তথ্য ও নথি আমাদের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। স্কুলটির দাবি প্রতিষ্ঠানে সর্বমোট ২০০ জন ছাত্রী আছে তাহলে ২৪ বছরে কেনো ২ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় অংগ্রহণ করবেন। আরো অবাক করা কাণ্ড যে শিক্ষা অফিসে তাদের কোনো তথ্য নেই। তার মানে এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আদৌ ছিলো না। দুই যুগ ধরে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো সরকারি লোকজন এখানে আসেননি বা তাদের পদধূলি এখানে পড়েনি। এভাবে চলছে আমাদের একাডেমিক স্বীকৃতি পাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান!

একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে পাঠদানের অনুমতি পেতে হলে অনেক গুলো গুরুত্বপুর্ন পথ অতিক্রম করতে হয়। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত ও ভৌগলিক রূপ দান করা। জমি থাকতে হবে দশমিক ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ, শ্রেণিকক্ষ ৫টি, অফিস কক্ষ ২টি, লাইব্রেরি, টয়লেট, কমনরুম, খেলার মাঠ থাকতে হবে। লাইব্রেরিতে বই থাকতে হবে ১ হাজার থেকে ২ হাজার পর্যন্ত। কম্পিউটার থাকতে হবে ৪টি থেকে ৬টি পর্যন্ত। সাধারণ ও সংরক্ষিত তহবিল মিলিয়ে লাখ টাকা থাকতে হবে। শিক্ষার্থী থাকতে হবে শহরে ১২০ থেকে ২০০ জন। আর মফস্বলে ৯০ থেকে ১৫০ জন। তাহলে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টির পাঠদানের অনুমতি কে দিলো? বছরের পর বছর শত শত শিক্ষার্থীর নামে নতুন বই বরাদ্দ রেখেছে সে বইগুলো কে বা কারা পড়লেন? যদি শিক্ষার্থী না থাকে তাহলে বইগুলো কোথায় গেল?
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রতিবেদন ২০২২ এ দেশের বর্তমান নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ নেই। উল্লেখ্ আছে জুনিয়র স্কুল ২ হাজার ৩৬৯টি, মাধ্যমিক স্কুল ১৬ হাজার ৫৩৮টি, স্কুল এন্ড কলেজ ১ হাজার ৪৪৬টি এবং আপগ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫০টি। মোট ২১ হাজার ৩টি ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে এমপিওভুক্তির জন্য আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা কারা। ওসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হিসাব কোথায়? সেখানেও তো হাজার হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেন।

দেশে হাজার হাজার এ রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যা দিনের পর দিন বন্ধ থাকে আণ্দোলনে আবার তারাই প্রথমে থাকে। কিন্তু যখন থলের বিড়াল বের হয়ে আসে তখন কেঁচো খুঁড়তে সাপের আর্বিভাব ঘটে। কর্তা ব্যক্তিদের সাফ জবাব এর জন্য দায়ী শিক্ষক ও কমিটি। কিন্তু ব্যবস্থা তো আগেই নেয়া যেতো। উপজেলায় যতোগুলো নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান আছে তাদের জরিপের আওতায় নিয়ে সতর্ক করা। ফলাফল হবে শিশু শিক্ষার্থীরা হেনস্তা থেকে রক্ষা পাবে।

গত ১ ডিসেম্বর ২০২২ এ প্রকাশ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি বিগত ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত নুরুন্নী দুলাল  প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিদ্যালয়টির প্রাথমিক পাঠদান ১ জানুয়ারি ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ, একাডেমিক স্বীকৃতি জানুয়ারি ২০১১ খ্রিষ্টাব্দ, মাধ্যমিক স্তরের পাঠদান অনুমতি জানুয়ারি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট এর অনুমোদন-অক্টোবর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ। প্রতিষ্ঠানটিতে শতভাগ ছাত্রীদের উপবৃত্তি বিদ্যমান রয়েছে। ২০০ থেকে ২৫০ শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা কোথায় যায়? এ অনিয়মের শেষ কোথায়? শিক্ষার্থীদের অপমানের দায় কে নেবে? 

লেখক: শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায় কর্মরত

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৪৩তম বিসিএসের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি বিএনপির - dainik shiksha ৪৩তম বিসিএসের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি বিএনপির যশোর বোর্ডের চেক জালিয়াতির মামলায় ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট - dainik shiksha যশোর বোর্ডের চেক জালিয়াতির মামলায় ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট র‍্যাগিং বন্ধে বুয়েটসহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিশন গঠন - dainik shiksha র‍্যাগিং বন্ধে বুয়েটসহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিশন গঠন ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও - dainik shiksha ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি - dainik shiksha শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি গণহারে ফেলের অভিযোগ নিয়ে এনটিআরসিতে গেলেন যারা - dainik shiksha গণহারে ফেলের অভিযোগ নিয়ে এনটিআরসিতে গেলেন যারা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049450397491455