মার্কিন জনগণের ইচ্ছার বিপরীতে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে নিক্সন প্রশাসনের বিলম্বের অন্যতম কারণ ছিলো ভুট্টোর পরিকল্পনায় পশ্চিম পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যে শিথিলতম হলেও একটি কনফেডারেশন গঠনের চেষ্টা। আমেরিকান পেপারে এই নতুন ইঙ্গিত মিলেছে। এর আগে জানা ছিলো, যুক্তরাষ্ট্র শুধু মুক্তিযুদ্ধকালেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে কনফেডারেশন গঠনের চেষ্টায় সহায়তা দিয়েছে । এই দলিল স্পষ্ট করেছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার মুক্তিলাভের জন্য ভুট্টোকে নির্দিষ্টভাবে কোনো বিষয়েই কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি বা ভুট্টোও কিছু দাবি করেননি ।
ওয়াশিংটনে ২৮ জুন, ২০০৫ এ প্রকাশিত নথি অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লেখা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের চিঠিতে আছে, শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চান। কিন্তু ভুট্টোকে অবশ্যই পাকিস্তানের বিভক্তি মেনে নিতে হবে। মুজিব নতুন বিভক্তিকে ‘দুই ভাইয়ের মধ্যে একটা বিভাজন’ এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তিন দিন পরে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি নিক্সনকে লেখা এই পত্রে লক্ষণীয়ভাবে দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী শিথিলতম কনফেডারেশন পরিকল্পনা থেকে ভুট্টোকে নিবৃত্ত করার প্রয়াসে নিক্সনের সমর্থন কামনা করেছেন। হিথ লিখেছেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান বিলম্বিত হলে উপমহাদেশে পাশ্চাত্যের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর সুযোগ নিতে পারে কমিউনিস্ট ব্লক। হিথের কথায়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানে সমস্যা শুধু সময়ের। বেশি আগে স্বীকৃতি দিলে তা পশ্চিম পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করবে এবং ভুট্টোর কাজ আরো জটিল হবে। অন্যদিকে আমরা যদি বেশি দেরি করি তাহলে পূর্বে (বাংলাদেশে) কমিউনিস্ট দেশগুলোর প্রভাব আমাদের চেয়ে প্রাধান্য পাবে এবং তাদের মিত্রদের অবস্থান শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বাস্তবতা ভুট্টো যাতে মেনে নেন, সেজন্য আপনার যে কোনো সাহায্য বিরাট উপকারে আসবে । তার (ভুট্টো) সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে এবং আমি জানিয়ে দিয়েছি, মুজিবের সঙ্গে আমার আলোচনায় তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। কিন্তু আমি জানি, আপনার (নিক্সন) মতামত ভুট্টো এবং তার সরকারের কাছে অত্যধিক গুরুত্ব বহন করে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চিঠিতে বঙ্গবন্ধুর লন্ডন সফর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘লন্ডনে মুজিবের আগমন ছিলো অপ্রত্যাশিত। তাকে বহনকারী বিমানটি যখন লন্ডন থেকে মাত্র ১ ঘণ্টার দূরত্বে, তখন আমরা ইসলামাবাদ থেকে বার্তা পাই, তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পরে তিনি (মুজিব) আমাকে বলেছেন, তিনি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, তাকে ঢাকায় পাঠাতে অথবা রেডক্রস বা জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করতে। ভুট্টোর তা মনঃপূত হয়নি। তিনি নিজেই তেহরান যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং শেষ পর্যন্ত লন্ডনে আসতে রাজি হন। আমি ঢাকায় যেতে তাকে একটি বিমানের ব্যবস্থা করি। এটা ছিলো তারই পছন্দ যে, তাকে যেন ভারতীয় বিমানে দিল্লিতে অবতরণ করতে না হয়। মুজিব আমাকে আরো বলেন, বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের যে কোনোই সুযোগ নেই, তা আমি ভুট্টোকে মুক্তিলাভের আগেই বলেছি।
পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন দূত ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ৪ পৃষ্ঠার এক টেলিগ্রাম বার্তায় উল্লেখ করেন, ভুট্টো আমাকে কিছুক্ষণ আগেই জানিয়েছেন, আজ ৩ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তিদানের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। তিনি আমাকে জানালেন, শেখ মুজিবের এই মুক্তি কোনো প্রতিশ্রুতি অথবা পূর্বশর্তসাপেক্ষ নয়। চীন ও রাশিয়া মুজিবের মুক্তির পক্ষে। প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে আমি তার করাচির বাসভবনে সাক্ষাৎ করি। ৪৫ মিনিটের এই আলোচনায় আমি মুজিবের মুক্তি সংশ্রিষ্ট কার্যধারা ও তার প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, তিনি এ নিয়ে এখনো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসেননি । কারণ বিষয়টি নির্ভর করছে তার ও শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনার ওপর এবং সেক্ষেত্রে মুজিবের ইচ্ছাকেই তিনি প্রাধান্য দেবেন। ভুট্টো এ প্রসঙ্গে আমাকে বলেন, পরিহাস হচ্ছে আমিও একদা এই কারাগারে এবং একই কক্ষে অন্তরীণ ছিলাম । আমি ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ওই সেল থেকে তাকে মুক্ত করে একটি গেস্ট হাউজে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করি এবং এই গেস্ট হাউজে আমিও এক রাত যাপন করেছিলাম। ভুট্টো মন্তব্য করেন যে, মুজিবকে তিনি বলেন, রাওয়ালপিন্ডিতে পৌছার পর থেকেই তিনি একজন ‘মুক্ত মানুষ’ । তিনি চাইলেই পিন্ডির গেস্ট হাউজ থেকে যখন খুশি তাঁর গন্তব্যে রওনা দিতে পারেন। কিন্তু তেমনটা করলে পাকিস্তানি জনগণের সামনে ভুট্টোর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে । মুজিব সেটা সর্বান্তকরণে সমর্থন করলেন।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে প্রেরিত এই টেলিগ্রামে আরো উল্লেখ করা হয়, মুজিবের সঙ্গে তার কথোপকথনের বিবরণ বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ছিলো; কিন্তু অপ্রত্যাশিত ছিলো না। ভুট্টো বলেন, মুজিব কার্যত সব বহিস্থ তথ্যের উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলেন । তিনি (মুজিব) ধারণা করেন যে, যুদ্ধের একটা উল্লেখযোগ্য পর্ব শেষ হয়েছে এবং ‘সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তানের একটি অংশ ভারত দখল করে নিয়েছে । আসলে পাকিস্তান ইতোমধ্যেই যে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে এর আকার-প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিলো না। ভুট্টো জানান, তিনি মুজিবকে যথাসম্ভব সব ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন এবং তার জন্য সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনের ব্যবস্থা করেন। প্রেসিডেন্ট আমাকে বলেন, মুজিবের সঙ্গে আলাপ- আলোচনার সময় তিনি কোনোভাবেই তার কাছে কোনো দাবি উত্থাপন করেননি।
মুজিবের কাছে কোনো প্রতিশ্রুতিই আদায় করতে চাননি। অথবা রাজনৈতিক অঙ্গনে মুজিবের প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি কোনো পূর্বশর্তও আরোপ করেননি । ভুট্টো আরো উল্লেখ করেন যে, ‘মুজিব তার কাছে সব ঘটনার বিবরণ ও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তাঁর অবস্থানের কথা জেনে তার মনে হয়েছে তিনি (মুজিব) বিস্ময়ে প্রায় বিমূঢ় (অলমোস্ট
স্ট্যান্ড) হয়েছেন এবং সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলদারিত্রে কথা জেনে তিনি খুবই হতাশ (হাইলি ডেসপন্ডেন্ট) হন বলেই তাঁর মনে হয়েছে। ভুট্টো আরো উল্লেখ করেন, ‘শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর আলোচনায় ভারতীয় দখলদারী ও কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে মুজিব বারংবার মন্তব্য করেন যে, তিনি কিছুতেই ভিক্ষা গ্রহণকারীদের একজন হবেন না।’
এই টেলিগ্রামটিতে আরো বলা হয়, ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সঙ্কটের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সময়ে মার্কিন নীতিতে ভুট্টো শুধু সন্তোষই প্রকাশ করেননি; এই অভিমত দেন যে, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অব্যাহতভাবে শুভেচ্ছা ও সমর্থন আশা করে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ভুট্টোর মন্তব্য : ‘এপ্রিলের আগ পর্যন্ত আমি নিজেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক পন্থায় একটি রাজনৈতিক সরকার গঠন করে রাজনৈতিক সমাধানের একটা চেষ্টা করছিলাম । তবে এক্ষেত্রে ভারতের অস্ত্রশক্তির ব্যবহার ছিলো অপ্রয়োজনীয় এবং অযৌক্তিক।’ ইয়াহিয়াকে রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে নিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ শুধু প্রশংসনীয় নয়, এটা বহুকাল স্মরণযোগ্য থাকবে । ভুট্টো আরো বলেন, ২৭ ডিসেম্বর একটি বেসামরিক সরকার গঠনের পর থেকে মার্কিন প্রয়াস ফলপ্রসূ ও মুজিবের মুক্তির মধ্য দিয়ে সেই প্রক্রিয়া আরো কার্যকর এবং পরিণামে তা‘নেগোসিয়েশনের’ পথ খুলে দিতে পারতো। কিন্তু ভুট্টোর কথায়, ‘এই প্রচেষ্টা এ কারণেই ভণ্ডুল হয়ে গেছে যে, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে উপমহাদেশের বিভক্তি ভারত কখনো মেনে নিতে পারেনি ।’
স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাধিক নথিপত্রে এটা স্পষ্ট যে, ১৬ ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরেও ভুট্টো একটি তথাকথিত শিথিল কনফেডারেশন গঠনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। ১৮ ডিসেম্বর ভুট্টো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্সকে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটি ‘শিথিলতম প্রকৃতির কনফেডারেল লিংক’ প্রতিষ্ঠার সুযোগ এখনো রয়েছে এবং তিনি সেই লক্ষ্যে উদ্যোগ নেবেন। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শীর্ষক ১৩ পৃষ্ঠার এক গোপন নথিতে দেখা যায়, ভুট্টো এমনকি বাংলাদেশে মার্কিন সাহায্য ও স্বীকৃতিদান প্রশ্নে রজার্সকে এই মর্মে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন যে, বাংলাদেশে মানবিক সহায়তাদানে প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেন বটে; কিন্তু তা যেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সমতুল্য হিসেবে প্রতীয়মান না হয়। এ ধরনের প্রক্রিয়া যেন তার সমঝোতার প্রয়াস বিঘ্নিত না করে। এই সারসংক্ষেপে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের বিজয়ের পরেও ‘শিথিলতম কনফেডারেশন’ নিয়ে নিক্সন প্রশাসনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলো। কারণ এই নথিতে বলা হয়, যখন আমরা বিশ্বাস করি যে, পৃথক বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা, তখন আমাদের অন্যরূপ আর কিছুই করা ঠিক হবে না। আগামী আরো কয়েক মাস আমাদের সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে যে, সাবেক পূর্ব প্রদেশ সম্পর্কে ভুট্টো কী ধরনের কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের প্রকৃতি এবং নিজ ভূখণ্ডের ওপর সার্বভৌমত্বের অর্থবহ অনুশীলনে বাংলাদেশের সামর্থ্য অথবা সামর্থ্যের অভাবকেও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে । এই দলিলে আরো বলা হয়েছে, ভুট্টোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের নিরিখেই জানিয়ে দেয়া উচিত যে, বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যেন ক্রমেই যথাসম্ভব উদাররূপ পরিগ্রহ করে এবং ভুট্টো যাতে তাঁর ‘হলস্টেন ডক্ট্রিন’ পরিহার করেন।
উল্লেখ্য, ওয়াল্টার হলস্টেনের নাম অনুসারে পরিচিত এই মতবাদ ১৯৫৫ ও ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময় পশ্চিম জার্মানির পররাষ্ট্রনীতির মুখ্য নিয়ামক ছিলো। এই মতবাদ অনুসারে পশ্চিম জার্মানি (তৎকালীন নাম ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি) মনে করতো, তারই শুধু বিশেষ অধিকার সমগ্র জার্মান জাতির প্রতিনিধিত্বে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বাদে পূর্ব জার্মানি যেসব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে পশ্চিম জার্মানি তাদের এড়িয়ে চলবে । ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে এই মতবাদ প্রথম প্রয়োগ করা হয় যুগোশ্লাভিয়ায়। এটা এক চীন নীতির সঙ্গেও তুলনীয় ।
পাদটীকা: প্রয়াত লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান এর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘১৯৭১: আমেরিকার গোপন দলিল’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
লেখক : মিজানুর রহমান খান, প্রয়াত সাংবাদিক, লেখক, গবেষক
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।