ভুয়া সনদে দুই যুগ ধরে প্রধান শিক্ষক

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি |

ছিলেন একটি কোম্পানির কর্মচারী। সেখান থেকে  স্কুলের দাতা সদস্যের মেয়েকে বিয়ের সুবাদে জাল সনদ দিয়ে অভিজ্ঞতা ছাড়াই হয়ে যান সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আর এভাবেই জাল সনদ ও অভিজ্ঞতা ছাড়া ২৪ বছর ধরে শিক্ষকতা করার অভিযোগ উঠেছে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার কৃষ্ণাদিয়া বাগুমৃধা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মাওলার বিরুদ্ধে। এছাড়াও বিদ্যালয়ের জমিতে বাড়ি করে বসবাস করা, বিদ্যালয়ের মাঠে মার্কেট করে বিক্রি করে দেয়া, বিদ্যালয় মাঠে বালু ভরাটে অনিয়ম, গাছ বিক্রি, গেট নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ফি, দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা না রাখাসহ বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।   

প্রধান শিক্ষক গোলাম মাওলা। ছবি : সংগৃহীত

নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই স্ত্রীকে অবৈধভাবে বিদ্যালয়ের সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসাবে নিয়োগসহ বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগও পাওয়া গেছে। এছাড়াও নিজে এককভাবে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনের আয়োজন করলে নির্বাচন স্থগিত করে উপজেলা প্রশাসন।

সম্প্রতি প্রধান শিক্ষক গোলাম মাওলার বিরুদ্ধে এই ধরনের বেশ কিছু অভিযোগ তুলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতার মেয়ে মিতা আহমেদ। পরে অভিযোগ আমলে নিয়ে শিক্ষা অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রধান শিক্ষক জাল সনদে চাকরি নিয়েছেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গড়িমসি ছিল, বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে প্রধান শিক্ষকের নিজ বাড়ি নির্মাণ, বালু ভরাটের ৯০ হাজার টাকার অনিয়ম, বিদ্যালয়ে গেট নির্মাণ না করে ২ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও গাছ বিক্রির ৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক গোলাম মাওলা ঝিনাইদহ জেলার বাসিন্দা। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আত্মীয়তার সুবাদে কৃষ্ণাদিয়া বাগুমৃধা উচ্চবিদ্যালয়ে যোগদান করেন সহকারী শিক্ষক হিসেবে। সেই বছরই প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য হলে গোপন কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওই বছরেই ১০ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়াই জাল সনদে তিনি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন। এ সময় যে-সব সনদ তিনি দিয়েছেন এতে দেখা যায়, এসএসসিতে দ্বিতীয়, এইচএসসিতে তৃতীয়, বিএ পরীক্ষা এবং বিএড দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

এসব সনদ অনুসন্ধান করে জানা যায়, গোলাম মাওলা বিএ পাস করলেও বিএড পাস করেননি। পরীক্ষা দিয়েছিলেন তবে তিনি পাস করতে পারেননি। তিনি বিএড পাশ করেছেন ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে, প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আর বিএড পাশের সার্টিফিকেট তুলেন ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে। তাহলে তিনি চাকরিতে যোগদান করলেন কোন সার্টিফিকেট দিয়ে। এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন সাময়িক সনদ দিয়ে যোগদান করেছিলেন কিন্তু সাময়িক সনদের কোনো ফটোকপিও তিনি দেখাতে পারেননি। তিনি প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদানের আগে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত ছিলেন। সেখান থেকে এসে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। 

তিনি অবৈধভাবে নিয়োগ নিয়ে ২৪ বছর ধরে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। তার স্ত্রী মুক্তা খানম ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়ে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে যোগদান করেছেন। কিন্তু তিনি লাইব্রেরিয়ান পাশ করেছেন ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। নিয়োগের চার বছর পরে লাইব্রেরিয়ান পাশ করেছেন। এই চার বছর তিনি বিনা বেতনে বিদ্যালয়ে চাকরি করছেন বলে জানালেও তিনি যে বিদ্যালয় থেকে বেতন নেননি তার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

এ বিষয়ে অভিযোগকারী মিতা আহমেদ বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মাওলা জাল সনদ দিয়ে ২৪ বছর পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরি করে যাচ্ছেন। প্রধান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় ১০ বছরের অভিজ্ঞতা এবং বিএড সনদ থাকতে হয় যা তার নেই । বিএড পাসের জাল সনদ দিয়ে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান শিক্ষক হয়েছেন। এছাড়াও বিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ বাণিজ্যসহ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব ঘটনা উল্লেখ করে আমার বাবা ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিস, দুর্নীতি দমন কমিশন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছিল। অদৃশ্য কারণে অভিযোগটি নিঃশেষ হয়ে যায়। আমাদের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি বাঁচাতে, এলাকার শিক্ষার মান রাখতে এই প্রধান শিক্ষকের অবসান জরুরি। তাই তার সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছি। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিয়ে এই প্রধান শিক্ষক গোলাম মাওলাকে বহিষ্কার করবেন।

বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য সাগর মৃধা জানান, আমার পিতা বেলায়েত হোসেন মৃধা ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ১ একর ৪ শতাংশ জমি এবং তৎকালীন সময়ে নিজের ১২ লাখ টাকা দিয়ে এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা। তবুও আমাকে এই বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য রাখা হয়নি। পরবর্তীতে আমি ১১ শতাংশ জমি কিনে বিদ্যালয়ের নামে দলিল করে দিয়ে বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য হয়েছি। বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের দ্বিতল ভবনটি আমার দানকৃত জমির ওপর নির্মিত। তারপরও আমাকে বিদ্যালয় থেকে সরানোর জন্য বিদ্যালয়ের সকল জমি মিউটেশন করলেও আমার দানকৃত জমি প্রধান শিক্ষক গোলাম মাওলা ষড়যন্ত্র করে মিউটেশন করাননি। প্রধান শিক্ষক তার স্ত্রীকে বিদ্যালয়ের সহকারী লাইব্রেরীয়ান পদে নিয়োগ দেন। তিনি এবং তার স্ত্রী বিদ্যালয়টি ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতের টাকা তারা লুট করে যাচ্ছে। আমি এই অবৈধ প্রধান শিক্ষকের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে নিয়োগকালীন সময়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জানান, আমাদের জানামতে ঐ সময়ে নিয়োগ অনিয়ম ছিল। আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে তাকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে নিয়োগ বোর্ডের এক সদস্য বলেন, গোলাম মাওলাকে আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তিনি লিখিত পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন প্রথম হয়েছিলেন আরেকজন। যিনি প্রথম হয়েছিলেন তার দুটি অঙ্ক কেটে গোলাম মাওলাকে প্রথম বানানো হয় এবং মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্নও তাকে আগে থেকেই দিয়ে দেয়া হয়েছিল। তার নিয়োগ পুরাটাই অবৈধ। তিনি প্রধান শিক্ষকের কোনো যোগ্যতাই রাখেন না।

কৃষ্ণাদিয়া বাগু মৃধা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মাওলা বলেন, এলাকার একটি কুচক্রী মহল আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। আমি জাল সনদে চাকরি করি না। আমার সকল সনদপত্র বৈধ। তবে তিনি স্বীকার করে বলেন আমার কোনো এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা নেই।

গোপালগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করতেছি। তার সমস্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করেছি। তার প্রেক্ষিতে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম ইমাম রাজী টুলু বলেন, প্রধান শিক্ষক এককভাবে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন দিতে চেয়েছিলেন। পরবর্তী সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত চলছে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শাহাদাৎ আলী মোল্লা বলেন, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে জেলা শিক্ষা অফিসার দুইজন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করেছেন। তারা তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পরে অভিযোগের সত্যতা প্রকাশ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

জেলা শিক্ষা অফিসার সাদিকুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসার সেই ফৌজিয়া এবার ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে - dainik shiksha ভিকারুননিসার সেই ফৌজিয়া এবার ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে ১৮ দিনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছি : উপাচার্য - dainik shiksha ১৮ দিনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছি : উপাচার্য উপদেষ্টা আসিফ-নাহিদের ছাত্র সংগঠনের সব কার্যক্রম স্থগিত - dainik shiksha উপদেষ্টা আসিফ-নাহিদের ছাত্র সংগঠনের সব কার্যক্রম স্থগিত যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস - dainik shiksha যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি - dainik shiksha এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক - dainik shiksha মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক - dainik shiksha ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0080900192260742