ভুল হলে সব শেষ

প্রশান্ত কুমার কর্মকার |

রাশিয়ান সাহিত্য সমালোচক ভিশারিয়ন বেলিনস্কি বলেছেন, মানুষ পশুও নয়, দেবতাও নয়। তাই তার প্রেম পাশবিক হবে না আবার নিষ্কামও হবে না, হবে মানবিক। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হয়েছে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে এক দফা দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ। তাই সবই হয়েছে। এখন দেশ বিনির্মাণের কাজ চলছে। এই পথ খব সহজ নয়, কঠিন ও র্দুগম। আর্দশগত পার্থক্য নির্বাচনে ভুল হলেই বিপদ। তাই রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনে কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা যেনো প্রতিফলিত না হয়। সেই দিকগুলো ছাত্র জনতাকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পাশাপাশি দেশে অরাজকতা যাতে না হয়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতাকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। 

সারা জাতি দেখছে, সারা বিশ্ব দেখছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা শুরু করেছেন দুর্বৃত্তরা। রাতের আঁধারে দোকানে, বাড়িতে লুটপাট করা হচ্ছে। দেশে যেনো অরাজকতা না করা হয়, হিন্দুদেরকে নির্যাতন-নিপীড়ন, মন্দির ও স্থাপনায় আঘাত করা না হয় বারবার আহ্বান করছেন। যে মানুষগুলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলো, সেই মানুষগুলো, তাদের সন্তানেরা সরাসরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সাহায্যে চেয়ে চিৎকার করতে দেখা গেছে। এই অরাজকতা আগে বন্ধ করার উদ্যেগ নিতে হবে। করতে হবে। যতো দেরী হবে, সময় যতো গড়াবে আন্দোলনের স্বপ্ন ফিকে হতে থাকবে। শিক্ষার্থীদের খেয়াল রাখতে হবে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় আক্রান্ত মানুষগুলো কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে সাহায্য চাইছেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কাছে সাহায্য চাইছেন। এটা আস্থার জায়গা, এই অর্জন যেকোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোরনের সমন্বয়কারী শিক্ষার্থীরা এ ধরনের হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ না করার জন্য গণমাধ্যমে বারবার অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দরাও আহ্বান করছেন। তারপরও থেমে নেই অরাজকতা, ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে, কারা করছে? এই এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি, মন্দির হয় হামলার প্রথম লক্ষ্যবস্তু। মন্দির, বাড়িঘর, সম্পদ লুট করা হয়। নারীদের ওপর চলে বর্বরতা, পৈচাশিক অত্যাচার, নিপীড়ন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পরও কেনো সেই হিন্দুরা আক্রান্ত। এদেশের হিন্দুরা সব সরকারের আমলে বৈষম্য বিরোধের শিকার। ১/১১ পট পরিবর্তনের সময়ও হিন্দুরা নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।

স্বাধীন দেশে মন্দির পাহারা দিয়ে রক্ষা করতে হয়। হিন্দুদের নিরাপত্তা, সুরক্ষার দাবি করতে হয়। জলের গানের দলনেতা রাহুল আনন্দ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে নিজের দলের সদস্য নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে দাঁড়িয়েছিলেন। তার বাড়িও তছনছ করা হয়েছে, যাকে শুধু দেশের মানুষ নন, বর্হিবিশ্বও চেনে। সারা দেশে সাধারণ হিন্দু পরিবারগুলোর কথা একটু  কল্পনা করুন। তাদের কী অবস্থা হতে পারে। প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে দিন রাতে সমান তালেই নীরব আতঙ্ক আর ভয়ের মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন। এই আতঙ্কের সংস্কৃতি থেকে মুক্তির দিশারী হতে পারেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। জন ডি, রকফেলার জুনিয়র বলেছিলেন, প্রত্যেক অধিকারের মধ্যে নিহিত রয়েছে একটা দায়িত্ব, প্রত্যেক সুযোগ-সুবিধার মধ্যে একটা নৈতিক বাধ্যবাধ্যকতা। তা অবশ্যই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মনে রাখতে হবে।   

                         

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগের পর বিজয় উল্লাসে একদল উচ্ছশৃঙ্খল মানুষ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ভাঙচুর, শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তিতে ভাঙচুর করে উল্লাস করছে। গণভবনে প্রবেশ করে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা শাড়ি-কাপড় নিয়ে উল্লাস করছে। এই উল্লাস যতো বাড়বে, ততোই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে প্রশ্ন বিদ্ধ করবে, তাতে পথ হারাতে পারে বাংলাদেশ।     

সরকারের পতনের পর পর রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র-জনতার মতো ভাবেন, নাকি নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হবেন। এই রাজনীতির খেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়েকেরা কতোটা সমন্বিত থাকতে পারবেন, তাদের সামনে সেইটিই সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এখন কিন্তু কোটা সংস্কার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার দিকে গোটা জাতি তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছেন সংখ্যা লঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, অনগ্রসর নৃগোষ্ঠী। যারা বরাবরই দেশের যেকোনো নির্বাচন ছাড়াও কোনো না কোনো অজুহাতে নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন। জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা কী সেই বৈষম্য আচরণের দায় থেকে দেশ মুক্ত হবে। বিএনপি রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, তাদের নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে, জনগণ তাতে সারা দেয়নি। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সফল হওয়ার পরপরই তাদের দীর্ঘদিনের দাবির একটি হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন। সুষ্ঠ রাজনৈতিক ধারার সংস্কৃতি গড়ে উঠুক। এটাই সাধারণ মানুষের চাওয়া। 

হযরত আলী (রা.) বলেছেন তোমার নিজের মধ্যে যে সব দোষ রয়েছে, অন্যের মধ্যে সেসব দোষ দেখে সমালোচনা সর্বাপেক্ষা বড় দোষ। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা যখন অন্যের সমালোচনা করেন, তখন নিজের দিকে তাকাতে ভুলে যান।

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে দেশের সব কার্যক্রম চলবে। রাজনৈতিকও অরাজনৈতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী বা দল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতায় পৌঁছানোটা কঠিন সমীকরণ ও সময়সাপেক্ষ। কারণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শিক্ষার্থীরা এককভাবে তাদের মেধা দিয়ে এগিয়ে আসছেন। পরে শিক্ষক ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ যোগ দিয়েছেন। সর্বশেষ যোগ দিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলো। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সভাপতি সংবাদ সম্মেলন করে বিচারপতিদের পদত্যাগ করার জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এই পরির্বতন কোনো রাজনৈতিক দলের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় হলে, সেই একই দলকানা গোষ্ঠীর শুধু পরিবর্তন হবে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের যথাযথ প্রয়োগ হোক, তাতে সকল আইনজীবীরা স্বাগত জানাবে। সুপ্রিম কোর্টে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হওয়ার ক্ষেত্রে একটি রীতি-নীতি ছিলো, বহু বছর আগেই এর কবর রচনা হয়েছে। অতীতের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো, প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ করেছিলেন। তা বাস্তবতার মুখ দেখেনি। কিন্তু সেই ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হতো তাহলে বাংলাদেশের প্রান্তিক দরিদ্র বিচারপ্রার্থী মানুষগুলোকে ঢাকা আসতে হতো না। অথচ বিচারপ্রার্থীদের জন্য বিচারালয়। এই বৈষম্যও দূর হওয়া আশু বাঞ্ছনীয়। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুল শক্তি ভুল পথে পা বাড়ায়, তাহলে এই দেশ ও দেশের মানুষগুলোকে এক চরম অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেবে। ১৯৭১ কে ইতিহাসের পাতা থেকে ছিড়ে ফেলা যাবে না। এই দেশ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাক হানাদারের হাত থেকে স্বাধীন হয়েছে। তা আমাদের মনে রাখতে হবে।  

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন দৈনিক প্রথম আলোতে ৫ আগস্ট অভিমত প্রকাশ করে বলেন, শ্রীলঙ্কা থেকে হাসিনার সরকার শিক্ষা নেয়নি। তিউনিসিয়া থেকে শিক্ষা নেয়নি। মিসরে কীভাবে হোসনে মোবারক জনরোষে উড়ে গেছে, সেখান থেকে সরকার শিক্ষা নেয়নি। জনগণের সরকার না হলে এমন পরিণতি হয়। এরশাদের চেয়ে শেখ হাসিনা ১০০ গুণ বেশি খারাপ হয়ে বিদায় নিয়েছেন। এরশাদ পালিয়ে যাননি। তিনি পালিয়ে গেছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ দলটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন। তার হিংসা, দম্ভ, অহংকার দলটাকে ধ্বংস করল।’ 

রবার্ট ই শেরউড়ের মতে সঙ্গীরা খারাপ হলে অপরাধ প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেখ হাসিনার তাই হয়েছে। তিনি দেশ ত্যাগের মধ্য দিয়ে শুধু তার দলকেই বিপদে ফেলে যাননি, দেশকে বিপদে ফেলে গেছেন। তাবেদার, সুবিধাবাদীদের ঘেরাটোপে শেখ হাসিনা একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধের ঐতিহ্যকে পদদলিত করে উল্লাসে মেতে উঠেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়েকেরা পথ হারাবে না। আর কোনো পারিবারিক রাজনৈতিক শক্তি, দুর্নীতিবাজ, সিন্ডিকেট ও জ্বি-হুজুর রাজনীতিবিদদের বন্দিজালে যেনো বাঁধা না পড়ে।

লেখক: আইনজীবী ও সাংবাদিক

[email protected]

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048511028289795