ভুয়া গবেষণাপত্র দেখিয়ে পদোন্নতির আবেদনের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
এ নিয়ে বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির একাধিক সদস্য দ্বিমত পোষণ করলেও বিভাগের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সুনজরে থাকায় পদোন্নতি বোর্ডও উতরে যান ওই শিক্ষক।
জানা গেছে, গণিত বিভাগের শিক্ষক আবদুল আলীম অধ্যাপক পদে একাধিকবার আবেদন করেন। প্রথমবার জমা দেওয়া গবেষণাপত্রে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ থাকায় পদোন্নতি বোর্ডের একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক আপত্তি জানান।
এতে আটকে যায় পদোন্নতি। বিপদ আঁচ করতে পেরে নিজেই পদোন্নতির আবেদন প্রত্যাহার করেন আবদুল আলীম। কিন্তু বছর না ঘুরতেই দ্বিতীয়বার আবেদন করেন তিনি। এতেও রয়ে যায় নানান অসঙ্গতি।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর অধ্যাপক পদে প্রথমবার পদোন্নতির আবেদন করেন আবদুল আলীম। যা একদিন পর ৯ ডিসেম্বর বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সভায় উত্থাপন করা হয়। বিভাগের শিক্ষকের পদোন্নতির আবেদনে সকলে সম্মতি জানিয়ে তা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশও করেন। কিন্তু ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি অধ্যাপক পদের পদোন্নতি বোর্ডে আবদুল আলীমের গবেষণাপত্রগুলোতে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ পাওয়া যায়। ওই সময় পদোন্নতি বোর্ডে থাকা একজন বিশেষজ্ঞ ওই শিক্ষকের গবেষণাপত্রগুলো সঠিক নয় বলে জানান।
পরে পদোন্নতি বোর্ড আরও অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বিভাগের পরিকল্পনা কমিটিতে পুনরায় পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যা ওই বছরের ৫ মার্চ অনুষ্ঠিত ৫৩৭ তম সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপন করা হয়। ওই সভার ৩৭(৪১) নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবেদনপত্রের ফাইলটি বিভাগের পরিকল্পনা কমিটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়। পরবর্তীতে কাগজপত্র বিভাগে এলে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি পরিকল্পনা কমিটিতে। উল্টো বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলেও বছর না ঘুরতেই দ্বিতীয় দফা অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেন ওই শিক্ষক। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর আবেদনপত্র জমা দেন তিনি।
দুইদিন পর ৭ ডিসেম্বর বিভাগের পরিকল্পনা কমিটিতে তোলা হয় পদোন্নতির আবেদন। কিন্তু এর আগে শিক্ষক আবদুল আলীমের করা পদোন্নতির আবেদন সম্পর্কে জানতে চান পরিকল্পনা কমিটির সদস্যরা। বিভাগের সভাপতি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানান তিনি।
পরবর্তীতে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিটির আরেকটি সভায় বিগত ১৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি উত্থাপন করা হয়। যেখানে আবদুল আলীমের পদোন্নতির আবেদনপত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
এরপর ওই শিক্ষকের দ্বিতীয়বার আবেদন পরিকল্পনা কমিটিতে উত্থাপন করা হলে সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে কাগজপত্র যাচাই করবেন বলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যাচাই-বাছাই শেষে প্রতিবেদন দেন পরিকল্পনা কমিটির সদস্যরা। প্রতিবেদনে ওই শিক্ষকের গবেষণাপত্রে অসংগতি খুঁজে পান তারা।
এদের মধ্যে কয়েকজন সদস্যের প্রতিবেদন এসেছে বাংলানিউজের হাতে। প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিক্ষক আবদুল আলীমের জমা দেওয়া দুটি গবেষণাপত্রের মধ্যে একটিতে অসংগতি পাওয়া যায়। ‘ম্যাথমেটিক্যাল অ্যানালাইসিস অফ এন ইকোলজিক্যাল মডেল ফর অ্যাসাসিং দ্য ইমিশান অফ এয়ার পলিউশন’ নামে গবেষণাপত্রটি গুগলে সার্চ করে কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ‘জার্নাল অফ ম্যাথমেটিক্যাল সাইন্স: অ্যাডভান্স অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন’ নামের জার্নালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয়েছে উল্লেখ থাকলেও গবেষণাপত্রের সঙ্গে থাকা ভলিউম নাম্বার, ইস্যুর নাম্বার অনলাইনে সার্চ করে পাওয়া যায়নি।
শিক্ষক আবদুল আলীমের গবেষণাপত্রটি ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখ থাকলেও জার্নালটিতে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের পর কোনও গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়নি। এমনকি জার্নালটিতে এডিটোরিয়াল বোর্ডের তালিকায় নাম থাকা এক সদস্যকে ই-মেইল করা হলে তিনি এ জার্নালের সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন।
পরিকল্পনা কমিটির সদস্য ও চবি গণিত বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. জালাল আহম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘তিনি (শিক্ষক আবদুল আলীম) পদোন্নতির জন্য যেসব কাগজপত্র দাখিল করেছেন তার মধ্যে একটি মানসম্মত ছিল না। তিনি যে গবেষণা জার্নালের নাম উল্লেখ করেছেন সেটি অত্যন্ত নিম্নমানের। এছাড়া গবেষণাপত্রটি যে জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে বলে দাবি করছেন, সেখানে তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি, তার কাগজপত্র পদোন্নতির শর্ত পূরণ করেনি’।
তিনি দাবি করেন, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া আবদুল আলীমের কাগজপত্রগুলোতেও বড় ধরনের অসংগতি রয়েছে।
বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির একাধিক সদস্য বিষয়টি নিয়ে কথা বললেও গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, গবেষণাপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করেছি। এতে অনেক গরমিল রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিটির একাধিক সদস্যের আপত্তি থাকার পরও কমিটির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে পদোন্নতি বোর্ডের কাছে সুপারিশ করেন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আমান উল্লাহ।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে দুই সভায় আলোচনা হয়। কমিটির সদস্যরা একাধিক পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমনকি তারা ব্যক্তিগতভাবেও মতামত দিয়েছেন। সর্বোচ্চ সাতদিনের মধ্যে আবেদনটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর নিয়ম থাকলেও পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্ত না পাওয়ার কারণে প্রায় দুই মাস আটকে ছিল বিভাগে। পরপর তিনটি পরিকল্পনা কমিটির সভা ডাকা হলেও শিক্ষকরা বিভাগে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও আসেননি। ফলে কোরাম সংকটে সভা করতে পারিনি। বিষয়টি আমি উপাচার্যকে অবহিত করেছিলাম। কোরাম না হওয়ায় পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনটি পাঠিয়ে দিয়েছি।
এদিকে, শিক্ষক আলীমের সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির আবেদনে দেয়া গবেষণাপত্রে চৌর্যবৃত্তি হয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করে। আবেদনপত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা গবেষণাপত্রগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিক্ষক আলীম ‘কনভ্যাক্স সলিউশন অফ দ্য ছুয়েডার ইকুয়েশন ইন ব্যানাক স্পেস’ নামে ‘জানুস ওয়ালসস্কি’ নামে পোলিশ (পোল্যান্ড) এক গবেষকের গবেষণাপত্র নকল করা হয়েছে। ‘ব্যানাক স্পেস’ এর স্থানে তিনি ‘হিলবার্ড স্পেস’ লিখেছেন। এছাড়া গবেষণাপত্রের কিছু বর্ণ ও শব্দে পরিবর্তন এনে জানুস ওয়ালসস্কির করা গবেষণাপত্রের এবস্ট্রাক, প্রিলিমিনারি সবকিছুই নকল করা হয়েছে। এমনকি মূল গবেষণাপত্রে রেফারেন্স হিসেবে যেসব বই ও লেখকের নাম উল্লেখ রয়েছে, সবগুলো বইয়ের নামও উল্লেখ করেছেন তিনি। শুধুমাত্র ‘এরউইন ক্রেজিক’ নামে একজন অতিরিক্ত লেখকের নাম বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শুধু এই গবেষণাপত্র নয়, আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটিও একই গবেষকের আরেকটি গবেষণাপত্র থেকে হুবহু নকল করা হয়। ‘অন মনোটনিক সলিউশন অফ দ্য ছুয়েডার ইকুয়েশন ইন ব্যানাক স্পেস’ নামে মূল গবেষণাপত্রটি থেকে শুধু কয়েকটি নতুন শব্দ যুক্ত করেন তিনি। তবে গাণিতিক সমস্যার সমাধানগুলো একই রয়েছে শিক্ষক আলীমের গবেষণায়।
গবেষণাপত্রগুলো যাচাই করে কয়েকজন গণিতবিদও এতে চৌর্যবৃত্তি হয়েছে বলে মত দেন। তারা বলেন, যেসব শব্দ বা গাণিতিক সংকেত পরিবর্তন করা হয়েছে তা গাণিতিক ফর্মূলার সমাধানে কোনো প্রভাব ফেলেনি। অর্থাৎ, তিনি নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারেননি।
অধ্যাপক পদে পদোন্নতির আবেদনকারী শিক্ষক আবদুল আলীম বলেন, আমার কাগজপত্র সবগুলোই ঠিক আছে। কোনও অসঙ্গতি পাওয়া যায়নি। বিভাগের সদস্যরাও এমন কোনও কিছুই বলেননি।
প্রথমবার অধ্যাপক পদে আবেদনে কোনও অসংগতি পাওয়া গিয়েছিল কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তখনও কোনও সমস্যা ছিল না। ওই সময় আবেদন প্রত্যাহারের বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক পদের জন্য প্রথমবার পদোন্নতি বোর্ডে থাকা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর চৌধুরী বলেন, বোর্ড চাইলে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করতে পারেন। তবে অবশ্যই গবেষণাপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কারণ এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম এবং শিক্ষার মান জড়িত থাকে। বিশেষ বিবেচনায় কাউকে পদোন্নতি দেওয়া হলে তা সার্বিকভাবে শিক্ষার জন্যই ক্ষতি।
তিনি বলেন, ‘আমি যখন পদোন্নতি বোর্ডে ছিলাম তখন তার গবেষণাপত্রে অসংগতি পেয়েছিলাম। এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছিলাম। বর্তমানে আমি বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছে। এখন কোন পদ্ধতিতে কিভাবে তিনি পদোন্নতি পাচ্ছেন তা আমার জানা নেই। যদি গবেষণাপত্রে কোনও অসংগতি থেকে থাকে, তা অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা উচিত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. বেনু কুমার দে এর সাথে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য জানা যায়নি।
গবেষণায় অসংগতি থাকলে কাউকে পদোন্নতি দেওয়া যায় কি-না এমন প্রশ্নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদ জানান, পদোন্নতি বোর্ড যদি কাউকে যোগ্য মনে করে, তাহলে সুপারিশ করতে পারে। গবেষণায় অসংগতির ব্যাপারে অভিযোগ এলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাচাই করতে পারে।
সূত্র : বাংলা নিউজ