ছয় দশক ধরে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলার মানুষের মন জয় করেছিলেন মওলানা ভাসানী। তার আন্দোলন ছিলো সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী।
তার রাজনৈতিক দীক্ষা হয়েছিলো ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে। আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বহু ঘটনার কেন্দ্রেই ছিলেন মওলানা ভাসানী, যাকে তার ভক্তরা ‘মজলুম জননেতা’ বলে সম্বোধন করতেন। আবদুল হামিদ খান ভাসানী জন্মেছিলেন ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে। অল্প কিছুকাল স্কুল ও মাদরাসায় পড়া ছাড়া তিনি অন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেননি।
শৈশবে পিতামাতা হারানো আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার কড়াকড়ি পছন্দ করতে পারেননি। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দুবছর তিনি দেওবন্দ মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। কিন্তু তিনি সেখানে বিদ্যাশিক্ষার চেয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামী রাজনৈতিক চেতনায় বেশি দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তার কর্মজীবন শুরু হয় টাঙ্গাইলের কাগমারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। তার জীবনযাপন ছিলো খুবই অনাড়ম্বর। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছিলেন ঢাকা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে এক অতি সাদামাটা ঘরে।
১৯১০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত ছিলো মূলত বাংলা ও আসামের কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্যে। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের সাহচর্যে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তার জাতীয়তাবাদী দলে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য হন তিনি।
সেই সময়ই তিনি প্রথমবারের মত কিছুদিনের জন্য কারাবাস করেছিলেন, যখন অনেক খ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্মী ও নেতার সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি।
আসামের ধুবড়ী জেলার ভাসানচরে তিনি এক বিশাল কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন। যার পর লোকমুখে তিনি ‘ভাসানচরের মওলানা’ বা ‘ভাসানীর মওলানা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে ‘ভাসানী’ শব্দটি তার নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে যুক্ত হয়ে যায়।
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে মওলানা ভাসানী যে ভূমিকা রেখেছিলেন তার দুটি পর্যায় ছিলো। এর একটি ছিলো ১৯৪৭ পূর্ব সময়ে অর্থাৎ ১৯১০ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই পর্যায়ে আন্দোলনের প্রধান ক্ষেত্র ছিলো আসাম। সেখানে তিনি বাংলাভাষী কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য আপসহীন সংগ্রাম করেন। শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই শুধু সামন্তবাদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয় তারই নেতৃত্বে। তিনি ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদের বাইরে রাজপথে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আসামের কুখ্যাত ‘লাইন প্রথার’ বিরুদ্ধে তার যে সংগ্রাম, তা দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তুলনীয়।
মওলানা ভাসানী ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে সিরাজগঞ্জের কাওয়াখালিতে বঙ্গ-আসাম প্রজা সম্মেলন নামে এক ঐতিহাসিক কৃষক সমাবেশ আয়োজন করেছিলেন। ওই সম্মেলনে জমিদারি উচ্ছেদ, খাজনার নিরীখ হ্রাস, নজর-সেলামি বাতিল, মহাজনের সুদের হার নির্ধারণসহ বহুবিধ প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার ফলে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় কৃষি খাতক আইন পাস হয়েছিলো এবং ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ঋণ সালিশী বোর্ড স্থাপিত হয়েছিলো।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ‘মজলুম জনতার’ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান জন্মের দু বছরের মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
‘তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ- পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক, যুবক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ভাষা আন্দোলনে লড়াই করেছে।
তিনি সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদেরও সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তার এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হকের যৌথ নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আজীবন তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন।
তিনি চেয়েছিলেন সকল জনগণের মুক্তি। তাই অসাম্প্রদায়িক একটা রাজনীতি গড়ে তোলার প্রয়োজনে পরে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার পক্ষে ছিলেন। বলা যায় তার উদ্যোগেই শব্দটি পরে বাদ পড়ে।
গোটা পাকিস্তান শাসনামলে তার রাজনীতির দুটি বড় উপাদান ছিলো স্বাধীনতা অর্জন এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং এই দুই প্রশ্নেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বের বিরোধ তৈরি হয়। এ কারণেই পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আর থাকতে পারেননি।
মওলানা ভাসানী এরপর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় করে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে একটি নতুন দল গঠন করেন যার নাম দেন ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ।
‘মওলানা ভাসানী’ নিজে একজন মওলানা ছিলেন। তিনি পীরও ছিলেন। কিন্তু তিনি ওইখানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি। তার কাছে স্বাধীনতার অর্থ ক্ষমতার হস্তান্তর ছিলো না। তার কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিলো রাষ্ট্রের চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা। স্বাধীনতার অর্থ ছিলো রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং সমাজে বৈষম্য দূর করা।
মওলানা ভাসানী ১৯৬৮-৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আরেকবার জাতীয় রাজনীতির কাণ্ডারি হিসেবে আর্বিভূত হন। ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের পেছনে তার ভূমিকা ছিলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুরু থেকেই তিনি তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন। তাতে কাজ না হওয়ায় আন্দোলনের পথ নেন মওলানা ভাসানী। এর ফলে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান এবং ওই রাতেই ভাসানীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন তিনি।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো শহর এবং গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও নিম্ন-আয়ের পেশাজীবীসহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে৷ ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের সেই ছাত্র অসন্তোষ গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ নভেম্বর পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘোষণা দেন, যার পর শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রাম। তিনি চলে যান ভারতে। কিন্তু সেখানে তিনি কার্যত নজরবন্দি ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটা গঠনমূলক বিরোধী রাজনীতির সূচনা করেছিলেন। সেইসময় যেসব নির্যাতন নিপীড়ন হতো তিনি তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তিনি যখন লক্ষ্য করলেন প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের ওপর কিছু কিছু শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে, তিনি তারও প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি ভারতকে বন্ধু হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা সমতার ভিত্তিতে, সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে। ভারত যখন ফারাক্কা বাঁধ দিলো এবং তার ফলে বাংলাদেশে মরুকরণের আশঙ্কা তৈরি হলো, তখন তিনি আন্দোলন মিছিল সংগঠিত করেন।
তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর একটি ঘটনা ছিলো ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে লং-মার্চ। সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই ছিলো তার জীবনের মূল লক্ষ্য। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অন্তিম দিনগুলোতেও তিনি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন।
মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে সমাহিত হয় ।