‘যে আশায় দুটি প্রাণ, বাঁধিলো সুখের ঘর
অসার কারণে হেথা, নাহি হোক বালুচর’
উইলিয়াম শেকসপিয়ার বলেছিলেন, বিশ্ব একটি নাট্যমঞ্চ..যেখানে আমরা ক্ষণিকের অভিনেতা মাত্র। কিন্তু এই ক্ষণিক সময়কেই মহামূল্যবান করে তুলতে পারে মানুষ। চিরায়ত নিয়মেই নারী-পুরুষের বন্ধন তৈরি হয় এবং এই মায়ার বাঁধনেই মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পায়। নারী-পুরুষের এই সম্পর্ককে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান এবং শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসাবে গন্য করা হয়েছে। কিন্তু কালের আবর্তে এই বন্ধনে যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে বহমান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করবো। বিষয়টি হলো, নারীদের বিবাহপূর্ব এবং বিবাহোত্তর জটিলতা। বিয়ের পূর্ব জটিলতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, নারীদের বিয়ের পথ ক্রমেই অমসৃণ হয়ে উঠছে। নির্দিষ্ট বয়স পার হওয়ার পরও বহু নারীর বিয়ে হচ্ছে না। এই সমস্যাটি বেশি হচ্ছে শিক্ষিত/উচ্চ শিক্ষিত নারীদের ক্ষেত্রে। ৯৫ শতাংশ নারীদের বিয়ে হয়ে যায় ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। ৫ শতাংশের বিয়ে হয় ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে ,৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে বেশ কিছু নারী ( উচ্চ শিক্ষিত ও কর্মজীবি) রয়েছে-যাদের নানা কারণে বিয়ে হচ্ছে না, বা তাদের জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
একজন পুরুষ বেকার নারীকে খু্ব সহজেই বিয়ে করে সংসার করতে পারেন। কিন্তু একজন চাকরিজীবী নারী একজন বেকার পুরুষকে বিয়ে করতে একেবারেই নারাজ। তাছাড়াও একজন উচ্চশিক্ষিত নারীকে শিক্ষা শেষ করে চাকরি নিতে অনেকটা সময় চলে যায়। বয়স বেড়ে যায় এবং উপযুক্ত পাত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। আশায় আশায় দিন কাটাতে থাকে ।কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হয় না। বয়স আরো বেড়ে যাওয়ায় বিয়ের সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হয়ে আসে।
আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু জরিপ করেছি এবং তথ্য-উপাত্ত সরেজমিনে নিয়েছি। আমি যে কর্ম এলাকায় রয়েছি-সেখানে আটজন উচ্চশিক্ষিত ভালো বেতনধারী কর্মজীবি নারী আছেন..যাদের বয়স ৩২ থেকে ৪০-এর মধ্যে। তারা হন্যে হয়ে পাত্র (বেকারকে নয়) খুঁজছেন। কিন্তু মেলাতে পারছেন না।এমন চিত্র বহু কর্ম এলাকায় বিদ্যমান। বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না হওয়ায় অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। ফলে সমস্যা আরো প্রকট ও ঘনীভূত হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত এবং কর্মজীবি নারীদের মধ্যে এক ধরণের উচ্চাকাঙ্খা তৈরি হয়, যেটির যথাযথ বাস্তবায়ন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের বাবা-মা খুব চিন্তায় থাকেন। তাই এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত কাউন্সিলিং প্রয়োজন।একজন কর্মজীবি নারী ইচ্ছা করলেই একজন বেকার যুবককে বিয়ে করে তাকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারেন। সামাজিক উদ্যোগ এক্ষেত্রে বড় টনিক হতে পারে। দ্বিতীয় সমস্যাটি, বিয়ে পরবর্তী সংসার ভেঙে যাওয়া। বিবাহবিচ্ছেদ এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে বর্তমানে।
বাংলাদেশ বিশ্বের এমন একটি দেশ যেখানে পারিবারিক বন্ধন ও সুখ-শান্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্যজীবন টিকিয়ে রাখার সংস্কৃতি আমাদের দেশে বহুকাল ধরে চলে আসছে। আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার দিকে মনোনিবেশ করে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা আমাদের দেশে বিবাহিত জীবন চালিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছি। বর্তমানে প্রায়ই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে-যা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সত্যিই বেমানান। মুসলিম আইনের অধীনে, বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি এবং এই চুক্তির মাধ্যমে দম্পতি একটি সুন্দর সংসার করার শপথ নেন। স্বামী-স্ত্রীর কোনো রক্তের বন্ধন নেই, তবুও তাদের পারস্পরিক আস্থা, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা তাদের সারাজীবন একটি সুন্দর সংসার করতে অনুপ্রাণিত করে। বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন..যা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর স্থায়ী হয়। খুব নির্দিষ্ট কারণে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তবে তা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে-এমন কী কুরআনেও। বিবাহবিচ্ছেদ কখনোই কাম্য হতে পারে না কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটা এখন আমাদের শহর ও গ্রামাঞ্চলে ঘটছে।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম পারিবারিক আইন এবং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন অনুসারে, জরুরি প্রয়োজনে বিবাহবিচ্ছেদ করা যেতে পারে। তবে বিবাহবিচ্ছেদ এখন আমাদের দেশে একটি ‘ফ্যাশন’ বলে মনে হচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং সামান্য ঝগড়ার কারণে দাম্পত্যজীবন নষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনের সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও উৎকন্ঠার। পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ১৮০ দিনে, ৪৫০০টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে। প্রতি ১ ঘণ্টায় সিটি করপোরেশনে একটি পরিবার ভাঙার আবেদন জমা পড়ছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি। বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে নারীদের কাছ থেকে এবং ৩০ শতাংশ পুরুষদের কাছ থেকে। বিবাহবিচ্ছেদের হার শিক্ষিতদের মধ্যে অনেক বেশি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে কম। একটি জরিপ দেখা গেছে-২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত রাজধানীতে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা প্রায় ৭০০০০। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে।
২২ ডিসেম্বর (২০২০) একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, জুন থেকে অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে বিবাহবিচ্ছেদের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে প্রতিদিন ৩৯টি তালাক হয়েছে, অর্থাৎ প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি তালাক। কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের পাঁচ মাসে ঢাকায় ৫৯৭০টি তালাক হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে ১২০০টি তালাক হয়। গত বছর গড়ে প্রতি মাসে ৯৫০টি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে ২৯.৭৮ শতাংশ।
বিবাহবিচ্ছেদের নিম্নলিখিত কারণগুলো পাওয়া যায়। ১. বর্তমানে মহিলারা তাদের অবস্থান সম্পর্কে খুব সচেতন,যা তালাককে ত্বরান্বিত করে। ২. আজকের যান্ত্রিক সভ্যতায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে-যা বিবাহবিচ্ছেদকে ত্বরান্বিত করে। ৪. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং ভালবাসা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে যা বিবাহবিচ্ছেদের কারণ। ৫. দাম্পত্যজীবনে সহনশীলতার অভাব তীব্র আকার ধারণ করছে। ৬. খারাপ মেজাজ, সন্দেহ, আত্ম-অহং, উদাসিনতা, অধৈর্যতা পরিবার ভেঙে যাওয়ার কারণ। ৭. সিরিয়াল, ফেসবুক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব পরিবার ভাঙার কারণ হিসেবে বিবেচিত। ৮. বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, মাদক সেবন এবং রোমান্সও বিবাহবিচ্ছেদের কারণ। ৯. অন্য মহিলাদের প্রতি স্বামীর আসক্তি বিবাহবিচ্ছেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।১০. নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ভুলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়া। ১১. স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আধিপত্যপূর্ণ মনোভাব। ১২.. যৌথ পরিবার ভেঙে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করা। ১৩. অফিস/কর্মস্থলে খুব ব্যস্ত থাকা এবং পরিবারকে সময় না দেওয়া। ১৪. কর্মজীবী মহিলারা পরিবারে বেশি সময় দিতে পারেন না, যা অনেকেই বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসাবে দেখেন। ১৫. দাম্পত্য জীবনের ছোটখাটো ভুল মেনে নেওয়ার প্রবণতা না থাকা। ১৬. ক্রমাগত দাম্পত্য জীবন নিয়ে সামাজিক চাপ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এবং এটি বিবাহবিচ্ছেদের একটি নিশিং কারণ। ১৭.. স্ত্রীকে যথাযথ ভরণপোষণ না দেওয়া। ১৮. যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন। ১৯. মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা এবং বন্ধ্যাত্ব।
বিবাহবিচ্ছেদের কারণ যাই হোক না কেনো, সেটার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এই বিবাহবিচ্ছেদ শিশুদের জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। বিবাহবিচ্ছেদের এই সংস্কৃতি একদিকে যেমন পারিবারিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে-অন্যদিকে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে। বিবাহবিচ্ছেদ নারীদেরও অনেক কষ্ট দেয় এবং তারা সমাজের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়। নারীরা তাদের দ্বিতীয় বিয়ের সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন এবং এর ফলে অনেক নারী তাদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আমাদের সমাজে এখনও বিবাহবিচ্ছেদের জন্য নারীদের দায়ী করা হয়। নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের চারটি কারণ চিহ্নিত করেছে জাতীয় মহিলা পরিষদ। ১. যৌতুক ২. বিবাহের বাইরে অবৈধ সম্পর্ক। ৩. মানসিক নির্যাতন। ৪. শারীরিক নির্যাতন। দাম্পত্য জীবনে ছোটখাটো ভুল ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু তার ভিত্তিতে সংসার ভেঙে যাওয়া কখনোই কাম্য হতে পারে না।
দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য স্বামী-স্ত্রীর সদিচ্ছাই যথেষ্ট। বিবাহবিচ্ছেদ একটি অসম্মানের বিষয়..যা পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে একটি পবিত্র বন্ধন সম্পূর্ণরূপে অসম্মানিত হয়। তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রীকে সমাজে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয় এবং গর্ব করে কারো কাছে মুখ দেখাতে পারেন না। তাই বিবাহবিচ্ছেদ এড়াতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই চেষ্টা করা দরকার। কিছু নির্দেশনা মেনে চললে তালাকের মতো খারাপ কাজ এড়ানো সম্ভব। ১. ধর্মীয় নির্দেশ মেনে চলা। ২. স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই পরিবারের কাজ ভাগ করে নেওয়া উচিত এবং একে অপরের কাজের প্রশংসা করা উচিত। ৩. স্বামী এবং স্ত্রীর একে অপরের সমালোচনা করা উচিত নয় এবং কিছু ভুল হলে তাদের ক্ষমা করার মানসিকতা থাকা উচিত। ৪. তাদের তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্ক করা উচিত নয় এবং সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হলেও নিজেকে সংযত করার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। সঙ্গীকে সময় দেওয়া এবং মিষ্টি করে কথা বলা স্বামীর কর্তব্য। উভয়েরই তাদের রাগ এবং বদমেজাজ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
করোনার কারণে প্রায় সবাইকে এক ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। মানুষের মধ্যেও অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। মনস্তাত্ত্বিক চাপ দাম্পত্য কলহকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। পারিবারিক কলহের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। অতীতে, মহিলারা বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইতো না, কারণ তাদের পরিবার তাদের আশ্রয় দিতে চাইতো না। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক অনুশাসন এবং সমাজের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের ইতিবাচক হস্তক্ষেপই বিবাহবিচ্ছেদ রোধ করতে পারে। পারিপার্শ্বিক চাপকে অব্যাহত রাখতে হবে দাম্পত্য জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য। । বিবাহ বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে এক ধরনের সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। বাপের বাড়িতে আশ্রয় কম থাকলে নারীরা তালাক চাইবে না। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের আত্মত্যাগের ওপর একটি দাম্পত্য জীবন টিকে থাকে।
লেখক : মাজহার মান্নান, সহকারী অধ্যাপক, বিএএফ শাহীন কলেজ, ঢাকা