মনেপ্রাণে শিক্ষক হতে হবে

দুলাল মিয়া |

৫ অক্টোবর। বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে  দিবসটি উদযাপিত হয়। শিক্ষকদের জন্য দিবসটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে স্মরণ করার জন্য এ দিনটিকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। শিক্ষকদের সম্মানার্থে পালিত এটি একটি বিশেষ দিবস। ২০২৩ এ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো-  ‘The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage’. ‘কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার  জন্য শিক্ষক : শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক অপরিহার্যতা।’ ওই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ সরকারিভাবে বাংলাদেশে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে  র‍্যালি, আলোচনা সভা ও সেমিনার  আয়োজন করতে বলা হয়েছে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে যে কোনো পরিবর্তন অবশ্যই শিক্ষকদের দিয়ে শুরু করতে হয়; অর্থাৎ শিক্ষকদের পরিবর্তন হলে শিক্ষার্থীর পরিবর্তন হয়। আর তখনই শিক্ষার পরিবর্তন ঘটে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে তা শিক্ষকদের দ্বারাই বাস্তবায়ন করতে হবে।

শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক অবস্থানে নিতে হলে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি, দায়িত্ব ও অধিকার, প্রশিক্ষণ, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

সীমাহীন বৈষম্যে ক্ষুব্ধ আজ দেশের বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। একসময় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ, যোগ্যতা ও মান নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। কিন্তু আজ তো তা নেই। এখন পিএসসির আদলে NTRC'র মাধ্যমে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে পাহাড়সম বৈষম্য বিরাজমান। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা মাত্র এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া পান। অথচ একজন সরকারি স্কুল ও কলেজের একই পদমর্যাদার শিক্ষক-কর্মচারী তাঁর জাতীয় বেতন স্কেলের ৪৫% বাড়িভাড়া পান। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা মেডিক্যাল ভাতা পান মাত্র ৫শ’ টাকা আর সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা পান ১৫শ’ টাকা। বেসরকারি শিক্ষকরা ঈদ বা পূজায় তাঁদের বেতন স্কেলের ২৫% উৎসব ভাতা পান। কর্মচারীরা পান ৫০% উৎসব ভাতা।  কিন্তু সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা তাঁদের বেতন স্কেলের সমপরিমাণ দুটি পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা পেয়ে থাকেন। সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা  শিক্ষাভাতা, স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা বীমা, যাতায়াত ভাতা, টিফিন ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চলের সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা হাওর, পাহাড়ি ও দুর্গম ভাতা, উপকূলীয় ভাতা, প্রমোশন, বদলি ও চাকরি থেকে অবসরের পর পেনশনসহ রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ন্যায় রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সকল দায়িত্ব সমভাবে পালন করার পরও রাষ্ট্র প্রদত্ত যৌক্তিক ও ন্যায্য প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫২ বছর পরও বঞ্চিতই রয়ে গেছেন।

বাংলাদেশে সরকারি ৩% এবং বেসরকারি ৯৭% শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশের তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (এমপিওভুক্ত)  রয়েছে। কিন্তু ওইসব সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চরম বৈষম্য বিদ্যমান। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে অনেক উন্নন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় সীমাহীন বৈষম্য বিরাজমান। যে কোনো দেশ বা জাতির উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। যে জাতি যতো বেশি শিক্ষিত, সে জাতি ততো বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। সময়ের সাথে সাথে দেশের অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নয়ন হচ্ছে না। বরং সময় যতো যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে। উন্নয়ন ও বৈষম্য একসাথে চলতে পারে না। তাই শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সকল অসঙ্গতি ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এর ব্যত্যয় হলে কাঙ্ক্ষিত  লক্ষে পৌঁছা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়বে।

বৈশ্বিক করোনা মহামারী, মানবিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও শিক্ষকসমাজ মানবিক, সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বিনির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করছেন। বাংলাদেশে আজ প্রথমবারের মতো সরকারি উদ্যোগে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদযাপিত বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সরকারের নিকট শিক্ষক সমাজের প্রত্যাশা হলো, শিক্ষা ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূরীকরণ ও চাকরি জাতীয়করণ।

শিক্ষক ছাড়া কোনো সমাজ নেই। প্রত্যেক মানুষেরই শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষকতা একটি মহান ব্রত। একটি উৎকৃষ্ট সমাজ বিনির্মাণে উৎকৃষ্ট শিক্ষকের বিকল্প নেই। আর একজন উৎকৃষ্ট মানুষই হতে পারেন একজন উৎকৃষ্ট শিক্ষক। উৎকৃষ্ট শিক্ষকের মর্যাদাও সবার উর্ধ্বে। যে সমাজে উৎকৃষ্ট শিক্ষকের সংখ্যা যতো বেশি, সে সমাজ ততোই উন্নত ও সম্বৃদ্ধ। দেশে সুনাগরিক সৃষ্টির লক্ষে শিক্ষকের সর্বাধিক সম্মান ও সম্মানী নিশ্চিত করা কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শিক্ষকের দায়িত্বও অনেক। একজন শিক্ষককে মনেপ্রাণে শিক্ষক হতে হবে। সুশিক্ষক হিসেবে উত্তম চিন্তা ও কর্ম করলে সমাজে উত্তম মানুষ তৈরি হবে। আর উত্তম মানুষ তৈরি হলেই শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস অমর হোক।

লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, জাউয়া বাজার ডিগ্রি কলেজ, ছাতক, সুনামগঞ্জ

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! এবারও ভারতে ছাপা হবে ১ কোটি পাঠ্যবই - dainik shiksha এবারও ভারতে ছাপা হবে ১ কোটি পাঠ্যবই ইউজিসিতে দুইজন নতুন সদস্য - dainik shiksha ইউজিসিতে দুইজন নতুন সদস্য বুয়েটের নতুন ভিসি অধ্যাপক বদরুজ্জামান - dainik shiksha বুয়েটের নতুন ভিসি অধ্যাপক বদরুজ্জামান উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি ওবায়দুল ইসলাম - dainik shiksha উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি ওবায়দুল ইসলাম ৬ষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি হতে না দেয়ার হুঁশিয়ারি বদলি প্রত্যাশীদের - dainik shiksha ৬ষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি হতে না দেয়ার হুঁশিয়ারি বদলি প্রত্যাশীদের নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যা যা করতে হবে - dainik shiksha ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যা যা করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন ডিজি আব্দুল হাকিম - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন ডিজি আব্দুল হাকিম কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028491020202637