তাপমাত্রা কিছুটা নিম্নমুখী হওয়ায় ঈদ-পরবর্তী সময়ে কমেছে বিদ্যুতের চাহিদা। ফলে লোডশেডিংও কমে। কিন্তু গতকাল হঠাৎই বেড়ে যায় লোডশেডিং। এ কারণে রাজধানীতে খুব বেশি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের খবর পাওয়া না গেলেও মফস্বলে লোডশেডিংয়ে ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন গ্রাহকরা। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, ময়মনসিংহ ও উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকার গ্রাহক ব্যাপক হারে লোডশেডিংয়ের তথ্য জানিয়েছেন। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে মফস্বলের জনজীবনে ভোগান্তির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলেও জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। এসব এলাকায় আরইবির পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত। বিআরইবি বলছে, বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহে খুব বেশি ঘাটতি নেই তাদের। তবে কিছুটা লোডশেডিং হওয়ার কথা স্বীকার করেন বিআরইবি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা দাবি করেন, যেসব এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে, তা প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত। বিশেষত সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঝুঁকি এড়াতে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদার পূর্বাভাস ছিল ১৪ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সর্বশেষ বিদ্যুৎ চাহিদার তথ্য বলছে, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৮২৮ মেগাওয়াট। তবে রাত ৯টা পর্যন্ত চাহিদা ও উৎপাদনে ঘাটতি দেখা যায় ৪৫০ মেগাওয়াটের মতো। চাহিদা ও উৎপাদনের এ তারতম্য আরো বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে।
দৈনিক যে পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা তৈরি হয়, তার অর্ধেকের বেশি চাহিদা আরইবির। আরইবি সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সংস্থাটির বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। সেখানে সরবরাহ পায় ৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। ২০০ মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিং ছিল আরইবি অঞ্চলে। খুব বেশি ঘাটতি না থাকলেও আরইবি অঞ্চলে লোডশেডিং এত বেশি হচ্ছে কেন সেটি পরিষ্কার হওয়া যায়নি।
তবে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিআরইবির সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী জানান, আরইবি অঞ্চলে এখন লোডশেডিং নেই বললেই চলে। যতটুকু লোডশেডিং হচ্ছে সেটি ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এছাড়া বাকি যেসব অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের খবর শোনা যাচ্ছে, তা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। বিশেষত বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। গতকাল আরইবির বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। সেখানে সরবরাহ পাওয়া গেছে ৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। ২০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং।
বিআরইবির বিদ্যুৎ চাহিদা ও সরবরাহের বিষয়টি জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, আরইবির বিদ্যুৎ চাহিদা ও সরবরাহে তারতম্য ৩৫০-৪০০ মেগাওয়াটের মতো। এ বিদ্যুৎ ঘাটতি সংস্থাটির জন্য অনেক বেশি।
ঈদ-পরবর্তী সময় থেকে দেশে খুব বেশি লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যায়নি। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদাও কমেছে। তবে দুদিন ধরে লোডশেডিং হঠাৎ বেড়েছে। বিশেষ করে গতকাল বিকাল ৪টার পর লোডশেডিং এক হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি পৌঁছে বলে পিজিসিবির তথ্য-উপাত্তে জানা গেছে।
পিজিসিবির দৈনিক ঘণ্টাপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও লোডশেডিংয়ের তালিকা বলছে, ৬ মে মধ্যরাতে ৫৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। এরপর গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ২০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হলেও বিকাল ৪টা নাগাদ তা ৯০০ মেগাওয়াটে পৌঁছে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিকাল ৫টায় ৬৫০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হয় পিজিসিবিকে।
এদিকে দেশের মফস্বল এলাকা থেকে গতকাল লোডশেডিং হওয়ার কথা জানান বিদ্যুতের গ্রাহকরা। বিশেষ করে মেহেরপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যায়।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা মতি মিয়া জানান, নেত্রকোনায় ব্যাপক হারে লোডশেডিং হচ্ছে। দিনে ও রাতে ২-৩ ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। কখনো আধা ঘণ্টা আবার কখনো ১ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত। এর মধ্যে লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি বেড়েছে।
বিপিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো সংকট নেই। তবে আরইবির ডিস্ট্রিবিউশন লাইন দুর্বল হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়। আরইবির বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়ার পরিস্থিতি থাকলেও অনেক সময় ভোল্টেজ আপ-ডাউনের কারণে লোডশেডিংয়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
বিপিডিবি-সংশ্লিষ্ট দুজন কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি হচ্ছে। মূলত দক্ষিণাঞ্চলের রামপাল ও বরগুনার বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে নেই। এ দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে রামপালের ৬৬০ মেগাওয়াট (প্রথম ইউনিট) ও বরগুনার ৩০৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এসব অঞ্চলে আরইবির অন্তত ২০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চাহিদা অনুযায়ী এসব সমিতি কিছুটা বিদ্যুৎ সরবরাহ কম পাচ্ছে। বিদ্যুৎ কম সরবরাহ হওয়ায় তা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের গ্রাহকদের মাঝে লোডশেডিং করে সমন্বয় করতে হচ্ছে।