মা-ছেলেকে হত্যার পর ভারতে পালিয়েও রক্ষা পেলেন না ঘাতক

গাজীপুর প্রতিনিধি |

গাজীপুরের শ্রীপুরে মা-ছেলে হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে শ্রীপুর থানা পুলিশ। এঘটনায় গ্রেফতার যুবক পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। সে জানিয়েছে, শারিরিক সম্পর্কে বাধা দেয়ায় মায়ের বুকে উপর বসে মা-ছেলেকে শ্বাসরোধে হত্যার পর ভারতে পালিয়ে যায়।

শুক্রবার দুপুরে শ্রীপুর থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান কালিয়াকৈর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আজমীর হোসেন। এসময় শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমজাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

কালিয়াকৈর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আজমীর হোসেন বলেন, গত ৭ জানুয়ারি বিকেলে জেলার শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামের দাইপাড়া এলাকায় বসত ঘর থেকে ২২ বছর বয়সী রুবিনা ও ৪ বছর বয়সী রুবিনা ছেলে জিহাদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। জোড়া খুনের হত্যা রহস্য ও ঘাতককে গ্রেফতারে পুলিশের একাধিক দল কাজ করে সবশেষ গত ৮ জানুয়ারি দিবাগত ভোর রাতে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার রহমত উল্ল্যাহ্ (২৯) গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের কুষদী গ্রামে গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। সে পরিবার নিয়ে নিহত রুবিনার বাড়ির পাশে ভাড়া থাকতো। নিহত রুবিনা (২২) শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামের সিরাজ মিয়ার মেয়ে ও তার চার বছর বয়সী ছেলে জিহাদ।

সহকারী পুলিশ সুপার আজমীর হোসেন জানান, বাবার দেয়া জমিতে উপজেলার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামে আধ পাকা বাড়িতে চার বছর বয়সী সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন রুবিনা। বনিবনা না হওয়ায় স্বামী ঝুমন পাশের মুলাইদ গ্রামের রঙ্গিলা বাজার এলাকায় তার পরিবারের সাথে থাকতো। রুবিনার বসত বাড়ির পাশেই পেশায় রং মিস্ত্রী রহমত উল্ল্যাহ্ ভাড়া থাকতো। রুবিনার আধা পাকা বাড়িটি রং করার জন্য রং মিস্ত্রী রহমত উল্ল্যাহ্ কাছে যান রুবিনা। সেখান থেকেই তাদের পরিচয় হয় এবং ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠলে রুবিনার বাড়ির বাজারসহ অন্যান্য কাজ রহমত উল্ল্যাহ্কে দিয়েই করাতো রুবিনা। তার বাসায় বিভিন্ন সময় লোকজন আসতো, তা দেখে তার সন্দেহ হয়। এক পর্যায়ে রহমত উল্ল্যাহ্ রুবিনার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি না হলেও এক পর্যায়ে রাজি হয় এবং রহমত উল্ল্যাহ্কে রাতে বাড়ি যেতে বলেও রুবিনা গেট খুলতো না। ঘটনার সাত দিন আগে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রুবিনা তার ব্যবহৃত মোবাইল থেকে রহমত উল্ল্যাহ্কে তলপেটে ব্যাথা করার কথা জানিয়ে ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে এনে দেয়ার জন্য বলে। বাড়ির পাশের পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে গিয়ে দেলোয়ারের ফার্মেসি থেকে ৭দিনের জন্য ঔষধ কিনে এবং নিজে খাওয়ার কথা বলে দুটি ঘুমের ট্যাবলেট কিনে রুবিনার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসে। গত ৩ জানুয়ারি দুপুর ১টায় রুবিনার বাড়ি গিয়ে তাকে ঘুমের ঔষধ খাওয়ার জন্য বললে বেলা আড়াইটায় ঘুমের ঔষধ খাওয়ার পর নিজের বাসায় চলে যায় রহমত উল্ল্যাহ্।

ওই দিন রাত ৮টায় রহমত উল্ল্যাহ্ রাতে খাবার খেয়ে শারীরিক সম্পর্কের জন্য রুবিনার বাসায় গেলে অর্ধঅচেতন অবস্থায় রুবিনাকে খাটের উপর শুয়ে থাকতে এবং ছেলে জিহাদকে মোবাইলে গেমস্ খেলা অবস্থায় দেখে জিহাদের ঘুমের অপেক্ষা করতে থাকে। রাত ১০টায় জিহাদ ঘুমিয়ে পড়লে খাটে শুয়ে থাকা অর্ধঅচেতন থাকা রুবিনার সর্ম্পকাতর জায়গায় হাত দেয় রহমত উল্ল্যাহ্। এসময় রুবিনা তাকে বাধা দেয়। পরে রুবিনার বুকে উপর বসে ধস্তাধস্তি করতে থাকলে হঠাৎ তাদের হাতটি ঘুমিয়ে থাকা জিহাদের গায়ের উপর গিয়ে পড়ে। শিশুটি চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে। জিহাদ যাতে চিৎকার করতে না পারে তাই সে ডান হাত দিয়ে জিহাদের গলা চেপে ধরে এবং বাম হাত দিয়ে রুবিনা গলা চেপে ধরে যাতে সেও চিকৎকার করতে না পারে। জিহাদ নিস্তেজ হয়ে গেলে সে মারা গেছে বলে সে বুঝতে পারে। এসময় তার চিন্তা হয়, সকালে রুবিনা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে ঘটনাটি সবাইকে বলে দেবে, সেই ভয়ে রুবিনার বুকের ওপর বসে গলা চেপে হত্যা করে রহমত উল্ল্যাহ্। এসময় তার ঘরে থাকা দুটি স্মার্ট ফোন, ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা ২ হাজার ৫০০ টাকা ও রুবিনার পায়ের নুপুর নিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে চলে যায়। ৭ জানুয়ারি ঘটনাটি জানাজানি হলে সে এলাকার মানুষদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলো।

তিনি আরও জানান, দুইদিন পর ৯ জানুয়ারি রাত ১২টায় পুলিশ খুঁজতে রহমত উল্ল্যাহ্ ভাড়া বাসায় গেলে সে দেয়াল টপকে পালিয়ে এবং রাতেই সে বাসায় ফিরে এসে কাউকে কিছু না বলে নরসিংদী ফুফুর বাসায় যায়। সেখানে একদিন থাকার পর টঙ্গীতে এ বন্ধুর বাসায় তিন-চারদিন অবস্থান করে। সেখান থেকে ভগ্নিপতির মাধ্যমে গোপালগঞ্জে দেবাশীষ নামের এক ব্যক্তি বাড়ি গিয়ে উঠে। দেবাশীষের কাছে রুবিনার ঘর থেকে নেয়া দুটি মোবাইল ফোন ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করে রহমত উল্ল্যাহ্। ওই টাকা নিয়ে এক দালালের মাধ্যমে যশোর সীমান্ত হয়ে ভারতে চলে যায়। ভারতের নদিয়া জেলার কৃষ্ণপুর থানা সংলগ্ন পেপসি কোম্পানিতে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ পায়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমজাদ হোসেন জানান, মা-ছেলের মরদেহ উদ্ধারের পর কোন ধরনের ক্লু খুঁজে পাচ্ছিলো না পুলিশ। নিহত রুবিনার স্বামীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তাতে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়াও হত্যার রহস্য জানতে পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় সোর্স নিয়োগ দেয়া হয়। তদন্তের এক পর্যায়ে গোপালগঞ্জ থেকে রুবিনার মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে জানা যায় রহমত উল্ল্যাহ্ দালাল মাধ্যমে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য।

তিনি জানান, রহমত উল্ল্যাহ্ ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণপুর থানার পেপসি কোম্পানিতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নেয়। পরে যশোর সীমান্তে বাংলাদেশের দালালদের মাধ্যমে ভারতের দালালদের সঙ্গে রহমত উল্ল্যাহ্ ফিরিয়ে আনতে যোগাযোগ করা হয়। পরে ভারতীয় দালালরা রহমত উল্ল্যাহ্কে চিহ্নিত করে এবং তার অবস্থান সম্পর্কে তারা জানালে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌছে দেয়ার জন্য তাদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। সবশেষ গত ৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩টায় তাকে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে পৌঁছে দেয় ভারতের দালালরা। সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

তিনি আরও জানান, যেদিন সে শ্রীপুর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় ওই দিন তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছিলেন, রহমত উল্ল্যাহ্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। তবে কারা তুলে নিয়ে গেছে তা তারা জানাতে পারেনি। এ বিষয়টি ছিলো রহস্যজনক।

শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, পুলিশী তৎপরতার পর রহমত উল্ল্যাহ্ ভারত চলে যায়, পরে কৌশলে দুই দেশের দালালদের মাধ্যমে তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সে হত্যাকাণ্ডে দায় স্বীকার করে নিয়ে গাজীপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২ এর বিচারক এখলাস উদ্দিনের আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ - dainik shiksha শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি - dainik shiksha ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025382041931152