তার প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি বিদ্যাসাগর নামেই বেশি পরিচিত। উনবিংশ শতকের বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাংলা ভাষার জনক বললে হয়ত ভুল বলা হবে না।
তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করেছিলেন। এবং তিনি যে শুধু বাংলা ভাষাকে যুক্তিগ্রাহ্য ও সকলের বোধগম্য করে তুলেছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাঙালি সমাজে প্রগতিশীল সংস্কারের একজন অগ্রদূত। আজ তার জন্মদিন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা ভগবতী দেবী।
ওই গ্রামের বাসিন্দা গৌরহরি সিংহ জানান গ্রামের যে বাড়িতে ঈশ্বরচন্দ্র বড় হয়ে ওঠেন সেই বাড়িটিতে এখন একটি পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত দুশ বই, আছে তার ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী।
ছেলেবেলায় গ্রামের পাঠশালাতে পড়তেন ঈশ্বরচন্দ্র। পাঠশালার পাঠ শেষ করে আরো শিক্ষালাভের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতায় পৌঁছান পায়ে হেঁটে, যখন তার বয়স মাত্র আট পেরিয়েছে।
বীরসিংহ থেকে কলকাতা ৫২ মাইল পথ। তার ভৃত্য কিছুটা পথ তাকে কাঁধে করে নিয়ে গেলেও এই দীর্ঘ পথ তিনি মোটামুটি নিজে পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিয়েছিলেন।
কাজের সূত্রে তখন কলকাতায় থাকতেন ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। কথিত আছে ঈশ্বরচন্দ্রের লেখাপড়ায় এতটাই আগ্রহ ছিলো যে বাসায় আলো জ্বালার যথেষ্ট সামর্থ্য পরিবারের না থাকায় তিনি রাস্তার আলোর নিচে পড়াশোনা করতেন।
১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে খুবই কৃতিত্বের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি নিয়ে পাস করেন তিনি এবং তখন থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এরপর তাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড পণ্ডিত পদে নিয়োগ করা হয়।
সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে তার প্রধান অবদান হচ্ছে দেশের সর্বসাধারণের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা এবং একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম তৈরি করা। ছয় মাসের মধ্যে তিনি বাংলার মেয়েদের জন্য প্রায় ৪০টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিদ্যাসাগর সারা জীবন লড়াই চালিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন বাল্যবিবাহের অবসান ঘটাতে। বিধবা বিবাহ প্রচলন করে নারীর অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে, বহুবিবাহ রহিত করে নারীকে অবিচার ও যন্ত্র্রণার হাত থেকে মুক্তি দিতে। সেই সময়ে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে মেয়েদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো।
সমাজে মেয়েদের খুবই ছোট চোখে দেখা হতো। কিন্তু যে দরদ নিয়ে এবং যেভাবে সাহসের সঙ্গে বিদ্যাসাগর তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য লড়াই করেছেন, তার কোনো তুলনা নেই।
বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি মনে করতেন, নারী জাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় যে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটিই ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যাসাগর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। বর্তমানে এটি বেথুন স্কুল নামে পরিচিত।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং এক বছরের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে বাংলার বিভিন্ন জেলায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৩৫টির বেশি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
স্ত্রী শিক্ষার সূত্রপাত ও বিস্তারে তার অবদান ব্যাপক। শুধু স্ত্রী শিক্ষাই নয়, সমাজের সকল স্তরের মানুষকে বিদ্যাসাগর শিক্ষার আলো দেখাতে চেয়েছিলেন। গ্রামের যেসব মানুষ শিক্ষার আলো থেকে ছিলো বঞ্চিত- বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ তাদের জন্য বিদ্যাসাগর মশাই প্রথম এই বীরসিংহ গ্রামে নৈশ স্কুল তৈরি করেছিলেন। কলকাতায় উচ্চশিক্ষার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাতেও পারদর্শী ছিলেন।
সাঁওতাল এবং দরিদ্রদের মধ্যে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। হোমিওপ্যাথি শিক্ষার জন্য তিনি বাড়িতে সেই সময় তার ষাট বছর বয়সে কঙ্কাল কিনে এনে অ্যানাটমি শিখেছিলেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন প্রাণপুরুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
তিনি বলতেন, ছাত্রদের পাঠ্য গ্রন্থে ধর্মের কথা বলতে গেলে ছাত্রদের মন প্রথম থেকেই নিজের স্বাভাবিকতা থেকে ধর্মের দিকে চলে যায়। তিনি তাই বলেছিলেন শিক্ষার ক্ষেত্র থেকে, পাঠ্যপুস্তক থেকে ধর্মের কথা, ধর্মনীতির কথা বাদ দিয়ে দাও। এটাই ছিলো বিদ্যাসাগরের সেক্যুলারিজমের মূল তত্ত্ব। তিনি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন তার ধর্ম হলো মানবতাবাদ - রিলিজিয়ন অব হিউম্যানিটি।
ঈশ্বরচন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব ছিলো তার স্বাধীন চিন্তায়- শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে। ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে বারবার বলেছেন শিক্ষা হতে হবে যুক্তি-ভিত্তিক।
সমাজের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর মধ্যেই ছিলো তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়। শুধু তাই নয় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তার অবদান ছিলো অসামান্য। বাংলা গদ্যের যে সৃষ্টি হলো, সেই গদ্য সৃষ্টিতে তার অবদান ছিলো অপরিসীম।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। গদ্যকে দখল করে তাকে যথার্থ সৌন্দর্য দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
সর্বস্তরের জন্য শিক্ষা বিষয়ক বই, শিশুদের বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন তিনি। তার কিছু কিছু পাঠ্যপুস্তক কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালি শিশুদের মৌলিক শিক্ষার প্রধান বাহন হয়েছে।
বাঙালি শিশুদের কাছে বেদগ্রন্থ ছিল তার লেখা বর্ণপরিচয়। বইটি এত সুন্দরভাবে সংগঠিত ছিলো যে বেশ কয়েকটি প্রজন্মের এই বই থেকে অক্ষর পরিচয় হয়েছিলো। বাঙালির সাক্ষরতা বিস্তারে এই বর্ণপরিচয়ের ভূমিকা ছিলো অসাধারণ। আর সেখানেই তিনি থামেননি। এর পরে লিখেছিলেন বোধোদয়, কথামালা এবং ধাপে ধাপে শিক্ষার একটা সিঁড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন।
১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্থাপন করেছিলেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামে একটি বইয়ের দোকান। ওই বছরই এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় হিন্দি ‘বেতাল পচ্চিসি’ অবলম্বনে লেখা তার বই বেতাল পঞ্চবিংশতি। প্রথম বিরাম চিহ্নের সফল ব্যবহার করা হয় এই গ্রন্থে। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে তিনি ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানাও স্থাপন করেছিলেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একদিকে ছিলো যেমন অসাধারণ বুদ্ধি ও মেধা, অন্যদিকে ছিলো চরিত্রের কঠোরতা এবং সংগ্রামী মনোভাব।
সমাজ সংস্কারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিরলস আন্দোলন সমগ্র বাঙালি জাতিকে নতুন পথে চলার রাস্তা দেখিয়েছিলো। একটা আদর্শ স্থাপন করেছিলো, একটা সংগ্রামের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিলো। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুলাই কলকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পরলোকগমন করেন।