এটা সবারই জানা, এখানে একজন শিক্ষক যে পদে যোগদান করেন..ওই পদেই শেষে তিনি অবসরে যান! শিক্ষাক্ষেত্রে এমন নজির পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই! আমরা সকলেই শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে নানা কথা বলি..অথচ শিক্ষকের মানোন্নয়ন নিয়ে এদেশের সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী সবাই যেনো নীরব! কিন্তু কেনো এই নীরবতা? অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হয়, এই পর্যায়ে উপনীত সম্মানিত ব্যক্তিরা বোধ হয় মাধ্যমিক স্তরকে বাদ দিয়েই শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেছিলেন!
দু’একজনের বিবেক এখনো শাণিত রয়েছে বলে মাঝে-মধ্যে আমরা আশান্বিত হই।যেমন,আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী..তিনি বিছানো লাল গালিচায় তাঁর শিক্ষক ডক্টর আনিসুজ্জামান স্যারকে হাঁটতে দিয়ে নিজে তাঁর পাশ দিয়ে..কিছুটা গালিচার নিচে পা রেখে তাঁর শিক্ষককে সযত্নে অগ্রভাগে রেখেছেন। অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে তাঁর পাশে হেঁটে সম্মানিত করেছেন। জাতিকে দেখিয়েছেন শিক্ষককে কীভাবে সমীহ করতে হয়!
সামাজিক ও আর্থিকভাবে শিক্ষকদের অবস্থার উন্নয়ন না ঘটাতে পারলে আগামী প্রজন্ম কাদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করবে তা কী আমরা ভেবে দেখেছি? অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে লিখেছেন, একদিন তিনি ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কে কে শিক্ষক হতে চাও? কেউ সেদিন হাত তুললো না! এই পেশাকে আকর্ষণীয় ও সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে না পারার কারণে আজ উচ্চ বা একই বেতন স্কেলে বা কখনো-কখনো নিম্নবেতন স্কেলের মেধাবীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন! এটা কী জাতির জন্য শুভ লক্ষণ?
মেধাবীদের এই ‘চলে যাওয়া’ বন্ধ করা না গেলে জাতি একদিন মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি-এটা খুব আশার কথা। কিন্তু আপনার শিক্ষক যদি স্মার্ট না হন..তাহলে তাঁকে অনুসরণ করা ছাত্র তথা দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা কীভাবে স্মার্ট হবেন? আর তাঁরা স্মার্ট না হলে কীভাবে বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত হবে? বর্তমানে শিক্ষকতার এই মহান পেশাটির সামাজিক তেমন মর্যাদা নেই, নেই আর্থিক নিরাপত্তাও। ফলে এই পেশাটি বর্তমানে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে।এর অন্যতম আরেকটি কারণ আগেই উল্লেখ করেছি।এই পেশায় প্রমোশন না থাকা বা পদোন্নতিবিহীন অবসর অর্থাৎ এখানে নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসতে চান না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মরহুম আকবর আলী খান বলেছিলেন, সার্ভিসের ক্ষেত্রে একজন চাকরিজীবীর বড় একটি অধিকারের বিষয় হলো- পদোন্নতি। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন সাপেক্ষে নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ না থাকলে একজন চাকরিজীবী তাঁর কর্মক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কাজ করতে পারেন না! আমরাও ‘একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্ধারিত যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন সাপেক্ষে নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ চাই’। আর সদাশয় সরকার এ সুযোগ তৈরি করতে পারলে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পাবে-আর্থিক নিরাপত্তা ও নিশ্চিত হবে। আর এই দুটি বিষয়ের নিশ্চয়তা পেলে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে তার জীবনের ব্রত করতে দ্বিধাবোধ করবেন না বলে আমরা মনে করি।
আমরা জানি, শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর শিক্ষক হলেন শিক্ষার মেরুদন্ড। প্রকৃতপক্ষে একটি দেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদেরই শিক্ষক হওয়ার কথা,আর এটা হলে ওই মেধাবী শিক্ষকদের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশ্বমানের স্মার্ট নাগরিক হয়ে উঠতে পারবেন। অথচ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ দেশের মেধাবীরা এখন আর শিক্ষকতায় আসতে চান না। তার কারণ তো উল্লেখ করেছি! আমাদের দেশে কিছুকাল ধরে একটি কথা প্রচলিত আছে আর তা হচ্ছে,‘যার নেই কোনো গতি, সে করে মাস্টারি’! এই অবস্থা একটি দেশের জন্য কতোটা ভয়ানক হতে পারে-রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা তা ভেবে দেখেছেন কী?
আমাদের দেশের জাতীয় শিক্ষা সেই ঔপনিবেশিক ধারাতেই রয়ে গেছে, ফলে আমরা শিক্ষাকে এখনো আশানুরুপ মানে নিয়ে যেতে পারিনি! বিশেষ করে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা এখনও পশ্চাৎপদই রয়ে গেছে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে। মাধ্যমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও কিছু দুর্বল ও পশ্চাৎপদ দিক হচ্ছে..
ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে রয়েছে বিশাল তারতম্য, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজারের কাছাকাছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যা পরিদর্শন ও মনিটরিং এককভাবে মাউশি’র অল্পসংখ্যক কর্মকর্তার পক্ষে সত্যিই অসম্ভব! অর্থাৎ দুর্বল পরিদর্শন ব্যবস্থা একই সঙ্গে যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব, শিক্ষা প্রশাসনের ওপেন সিক্রেট দুর্নীতি, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং জাতীয় বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দের অপ্রতুলতা!
শিক্ষা ক্ষেত্রের আধুনিকায়ন তথা উন্নয়নে বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের আধুনিকায়ন এবং বিশ্বমানের নাগরিক তৈরি করতে মাধ্যমিক স্তরকে যেভাবে সাজাতে হবে:
ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ১: ৩০/৪০(সর্বোচ্চ) পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় বাজেটে এর বরাদ্দ বাড়াতে হবে, মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে এবং ধরে রাখতে শিক্ষকদের জন্য একটি মানসম্মত স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালু করতে হবে, শিক্ষকদের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে এবং নির্ধারিত দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে অন্তত চার স্তরীয় একটি একাডেমিক পদসোপান/পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে, শিক্ষা প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত এবং জাতীয় সংসদে পাসকৃত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে ভেঙে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর নামে দুটি আলাদা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শক্তিশালী পরিদর্শন ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় গবেষণার ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা রয়েছে তা যেমন দূর হবে তেমনি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হবে এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
লেখক: মোঃ ওমর ফারুক, শিক্ষক
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।