মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন সংস্কার

জাকারিয়া স্বাধীন , দৈনিক শিক্ষাডটকম |

বলা হয় শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। দিনের আলোয় দেখা যাক বা না যাক শিক্ষার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা জানে শিক্ষার মেরুদণ্ড শিক্ষা প্রশাসন। অথচ শিক্ষার অন্যতম স্তম্ভ মাধ্যমিক স্তরের মাঠ প্রশাসন যারা গোড়াপত্তন করেছে তাদের জীবন যেনো নির্মম কারাদণ্ড। একসময় দেশে মাধ্যমিক শিক্ষার মাঠ প্রশাসন বলতে তেমন কিছুই ছিলো না। না ছিলো নিজস্ব দপ্তর, না ছিলো নিজস্ব জনবল। শিক্ষার পরিধি বিস্তৃতির সঙ্গে বর্তমান উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসাররা মাঠ পর্যায়ে এ পদের গোড়াপত্তন করেছেন। পরিক্রমায় এ পদকে আবশ্যক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশে একটি পদ প্রতিষ্ঠা করার কণ্টকাকীর্ণ অকূল সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু নির্মম সত্য হলো পেশা জীবনের সায়াহ্নে এসেও কোনো প্রমোশন ছাড়াই তাদের অবসরে যেতে হচ্ছে।

মাধ্যমিক পর্যায়ের কাজের বিস্তৃতি, মাঠ প্রশাসন শক্তিশালী করণ এবং মনিটরিং ও সুপারভিশন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সেসিপ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হয়। যার মাধ্যমে বর্তমান আঞ্চলিক অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস,  মহানগরে পঁচিশটি থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। সেসিপের আওতায় একাডেমিক সুপারভাইজার, সহকারী পরিদর্শক, সহকারী প্রোগ্রামার, ডিস্ট্রিক্ট ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর, গবেষণা কর্মকর্তা, মহানগরে থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার প্রভৃতি পদগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে। যেখানে নিয়োগে প্রারম্ভিক যোগ্যতা চাওয়া ছিলো মাস্টার্স এবং পদ অনুযায়ী শিক্ষায় প্রফেশনাল ডিগ্রি। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিভিন্ন পর্যায়ে এসব জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের আইইআর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েটধারীরা শিক্ষাকে ব্রত করে, শিক্ষাকে ভালোবেসে, শিক্ষা নিয়ে স্বপ্ন দেখে, যাদের প্রায় সবাই স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে নিবন্ধনধারী এবং অধিকাংশই বিভিন্ন সরকারি ও ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে শিক্ষা বিভাগে কাজ করতে এসেছেন। নিদারুণ সত্য হলো ১০ থেকে ২২ বছর সাকুল্য বেতনে কাজ করা বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অভিজ্ঞ এ দক্ষ জনবলের ভাগ্য যেনো নির্মম পরিহাস! একটি উদাহরণ দিই-অত্যন্ত অসচ্ছল পরিবারের একমাত্র ছেলে আবদুল হাকিম; তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বাবা মারা যান। এরপর বিধবা মায়ের জীবন সংগ্রামে অজপাড়াগাঁয়ের স্কুল-কলেজ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার পর সেসিপের মাধ্যমে নিয়োগকৃত হয়ে মাধ্যমিক শিক্ষায় কাজ করেন। একদিন কর্মস্থলে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। প্রজেক্টে চাকরি করায় তার বিধবা ও সন্তানহারা মা রাষ্ট্র থেকে এক টাকাও পাননি। এমন বহু উদাহরণ আছে শিক্ষায় স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে এসে কেউ জীবন হারিয়েছেন, কেউ পঙ্গু হয়েছেন। অথচ রাষ্ট্র থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা তো পাননি এমনকি তার দপ্তর কোনোদিন খোঁজও নেয়নি! উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এবং সেসিপের আওতায় নিয়োগকৃতদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা অফিসের গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজ শিক্ষা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ যেখানে প্রশাসনসহ প্রায় সব বিভাগই কোনো না কোনোভাবে শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, কারিগরি, মাদরাসা, অন্যান্য ও আলাদা অধিদপ্তর সব মিলিয়ে শিক্ষা এক বহুমাত্রিক জটিল বিভাগ। 

সবগুলো দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তারপর আবার শিক্ষার মাঠ প্রশাসনে মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো নিজস্ব জনবলই নেই। বহুমুখী চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কোনো কাজ কিন্তু থেমে নেই। প্রাথমিকে বিদ্যালয়ের সংখ্যা অনুপাতে সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের পদ আছে। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে পদ ও জনবলের অপ্রতুলতা আশঙ্কাজনক। প্রায় ছত্রিশ হাজার প্রতিষ্ঠানের ছয় লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা পরিবার। শিক্ষার মাঠ প্রশাসনে নিয়োগ-প্রমোশন ও বদলি জটিলতায় স্থবিরতা বিরাজমান। মামলা, পক্ষ-বিপক্ষের তৎপরতা আর অতিতৎপরতায় অনেক ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না। মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কার সাধন ও স্থবিরতা কাটাতে কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালা একাধিকবার করা হয়েছে। কিন্তু কোনো নীতিমালাই সম্পূর্ণ নয় বরং প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সময়ের সঙ্গে এই নীতিমালা পুনঃযাচাই জরুরি। শিক্ষা প্রশাসনের প্রাথমিক পদ সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে ৯৭ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে নিয়োগের সুযোগ রাখা প্রয়োজন। নিয়োগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করা যেতে পারে। দীর্ঘদিন বঞ্চিত সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষকদের প্রমোশন ও পদায়ন জটিলতা দূর করা জরুরি। প্রমোশনের সর্বোচ্চ স্তর উপ-পরিচালক। যার পদ সংখ্যা খুবই সীমিত। এখানে পদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও পদোন্নতির মাধ্যমে উচ্চ পদে যাওয়ার পথ সুগম করার দাবি যৌক্তিক। 

চাকরির শেষ সময়ে এসে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের প্রমোশন দীর্ঘসূত্রতা হতাশাজনক। তাদের প্রমোশনে আশু ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে নিভৃতে কাজ করে যাওয়া সেসিপের জনবলের গুরুত্ব বিবেচনায় নির্বাহী আদেশ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এমনকি উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের অসমাপ্ত কাজ দ্রুত সমাপ্ত করা সর্বোত মঙ্গলজনক হবে। কোনো অপগোষ্ঠীর হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে না দিয়ে অপ্রয়োজনীয় মামলার বাধা অপসারণ করে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন গতিশীল করা এখন সময়ের দাবি। মাধ্যমিক শিক্ষা এক অবিচ্ছেদ্য পরিবার। এখানে যার যার অবস্থান থেকে সবাই অবদান রাখছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষার্থীদের কল্যাণে শিক্ষার বৃহৎ স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাধ্যমিক শিক্ষাকে, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানাই।

লেখক: গবেষক (মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঢাবি-জাবিতে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দুঃখ প্রকাশ - dainik shiksha ঢাবি-জাবিতে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দুঃখ প্রকাশ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে যা বললেন সারজিস - dainik shiksha সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে যা বললেন সারজিস পিটিয়ে হত্যার আগে সেই ব্যক্তিকে ভাত খেতে দিয়েছিলেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha পিটিয়ে হত্যার আগে সেই ব্যক্তিকে ভাত খেতে দিয়েছিলেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণির বিষয়-গ্রুপ পরিবর্তনের সময় বাড়লো - dainik shiksha দ্বাদশ শ্রেণির বিষয়-গ্রুপ পরিবর্তনের সময় বাড়লো ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা - dainik shiksha ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার প্রস্তাব - dainik shiksha সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042951107025146