মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। প্রজাতন্ত্রের গণমানুষকে যোগ্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই বলা হয়ে থাকে, জীবনের জন্যেও শিক্ষা আবশ্যক। পৃথিবীতে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি ততো সভ্য এবং উন্নত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়শীল দেশেগুলোর উচিত জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা পরিবেশ তৈরি করে দেশের শিক্ষার্থীদের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে প্রধান্য দেয়া। বিদেশি স্কলার হায়ার না করে দেশের নবীন স্নাতকদের ওপর আস্থা রেখে-তাদের নানা প্রকল্পে কাজের সুযোগ দেয়া। এতে তাদের মেধার যেমন মূল্যায়ন হবে, তেমনি প্রথম কর্ম অভিজ্ঞতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা আরো বড় বড় প্রকল্পে যুক্ত হয়ে নিজেদের যোগ্যতা যাচাই করতে পারবে। আর এ জন্য দরকার সরকারের আন্তরিকতা। মাধ্যমিক স্তর থেকে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতা যাচাইয়ের সুযোগ করে দিতে হবে। সুপ্ত প্রতিভা অন্বেষণ করে জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য মাধ্যমিক স্তরের সম্মানিত শিক্ষকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্ব শর্ত। শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি আলোকিত হয়। দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যায়। শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা । যেখানে শিক্ষা নেই, সেখানে জ্ঞান ও মূল্যবোধ অনেক দুর্বল। ফলে, সেখানে বিবেকবান মানুষ আশা করা যায় না। একবিংশ শতাব্দীর এই পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর এ জন্য সুশিক্ষিত ও কর্মঠ জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের ছাত্রজনতার গণঅভ্যত্থানের সুফল পেতে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্তমেধা ও অবারিত সম্ভবনার দ্বার উন্মুক্ত করে জ্ঞানের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষিত জাতি সমাজের সম্পদ। কিন্তু শিক্ষা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহলে সে সমাজ কখনো দেশকে এগিয়ে নিতে পারে না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও গেলেও বাংলাদেশ শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান ত্রুটিগুলো চিহ্নিতকরণ এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা এই লেখার উদ্দেশ্য।
শিক্ষার গুণগতমান অর্জন যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষার গুণগতমান অর্জন বলতে এর গুণগত মান নিশ্চিতকরণকে বোঝায়। শিক্ষার গুণগতমান আন্তর্জাতিকভাবে তুল্য মানকে নির্দেশ করে। শিক্ষার মান্নোনয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান উপাদানগুলো হলো- শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাক্রম, শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন, শিক্ষার প্রয়োজনীয় পরিবেশ এবং ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ। ধারাবাহিকভাবে এ সকল উপাদানের উন্নয়ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগতমানের টেকসই উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব। এক্ষেত্রে অংশীজনদের ভূমিকাও নিতান্ত কম নয়। ‘বাংলাদেশকে তার বিশাল জনগোষ্ঠীর জনমিতিক সুফল পেতে হলে এ জনগোষ্ঠিকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। আর সেজন্য শিক্ষার আধুনিকায়নের বিকল্প নেই। আর এই আধুনিকায়নের শুরুটা হতে হবে অবশ্যই একটি কার্যকর যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে যা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বর্তমান যুগের সাধনার সঙ্গেই বর্তমান যুগের শিক্ষার সঙ্গতি হওয়া দরকার। রাষ্ট্রীয় গণ্ডি-দেবতার যারা পূজারি তারা শিক্ষার ভেতর দিয়ে নানা ছুতায় জাতীয় আত্মম্ভরিতার চর্চা করাকে কর্তব্য মনে করে। জার্মানি একবার শিক্ষাব্যবস্থাকে তার রাষ্ট্রনৈতিক ভেদবুদ্ধির ক্রীতদাসী করেছিলো বলে পশ্চিমের অন্যান্য জাতি তার নিন্দা করেছে। পশ্চিমের কোন্ বড় জাতি এ কাজ করে নি? আসল কথা, জার্মানির সব বিভাগেই বৈজ্ঞানিক রীতিকে অন্যান্য সব জাতির চেয়ে বেশি আয়ত্ত করেছে, সেইজন্যে পাকা নিয়মের জোরে শিক্ষাবিধিকে নিয়ে স্বাজাত্যের ডিমে তা দেয়ার ইনকিউবেটর যন্ত্র সে বানিয়েছিলো। আমাদের দেশে কি সেই লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি? লক্ষণীয় যে রবীন্দ্রনাথ এখানে সাধনার কথা বলেছেন। সাধনা হচ্ছে সর্বোচ্চ সক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ। বর্তমান যুগকে আমরা তথ্য-প্রযুক্তির যুগ বলে অভিহিত করি। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন তথ্য অত্যন্ত সহজলভ্য। ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত একেকটি মুঠোফোন একেকটি গ্রন্থাগারও বটে। কিন্তু তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তরের এবং জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেয়ার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, আমাদের শিক্ষা কি তা উৎসাহিত করে? আমাদের শিক্ষার সংকটের মূলে আছে শিক্ষা সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের সমাজ শিক্ষাকে একটি সুযোগ বলে ভাবে, অধিকার হিসেবে ভাবে না। অথচ রাষ্ট্রপরিচালনার প্রবিধান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি : মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা ১৫-এর (ক) অনুচ্ছেদে ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। সেখানে শিক্ষার অবস্থান চতুর্থ। শিক্ষার পরে চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১৭-এর (ক), (খ), (গ) নং অনুচ্ছেদে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে,“রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কতগুলো সমস্যা আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্জনকে বাঁধাগ্রস্ত করছে। যা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও অন্তরায়। এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো তার শৈশব। এ সময় শিশুরা হাসবে, কাঁদবে, খেলবে। শৈশবের দুরন্তপনা, কৈশোরের দুষ্টমিষ্টি রাগ-অভিমান জীবনকে নানাকৌণিক দিক থেকে দেখার এক অবারিত সুযোগ। কিন্তু শিশু বয়সে প্রাথমিক সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সাটিফিকেট (জেএসসি)-এ দুটো পাবলিক পরীক্ষা চালু করায় আমাদের সন্তানদের শৈশব ও কৈশোরকাল ধ্বংস করে দিয়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের সন্তানদের ফেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তায়। তবে আশার কথা হলো সম্প্রতি পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা দুটো বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক, অভিভাবকরা পরীক্ষার অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে পারেন নি। শিশুদের জ্ঞানচর্চা নয় বরং ফলাফল নিয়ে অভিভাবকদের আকাশচুম্বি প্রত্যাশা এবং অপ্রাপ্তির হতাশা শিশুদের পারিবারিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। পরীক্ষাগুলোতে বড় সংখ্যায় শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য হওয়ার ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি। ইলেকট্রোনিক্স গেজেটের ব্যবহারকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। কিন্তু করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে শিশুদের হাতে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেটটি তাদের বই বিমুখ করেছে। অতিরিক্ত ভিডিয়ো গেমস, ফেসবুক, টিকটক, পাবজি, টু্ইটারে আসক্তির কারণে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অল্প বয়স্ক অবুঝ এই ছেলে-মেয়েরা নতুনত্বের মোহে ইন্টারনেটের অলীক ফাঁদে পা দিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। চারিত্রিক স্খলন ও কুসঙ্গের প্রভাব বেড়েছে। নিজের সৃজনশীল শক্তিকে কাজে না লাগিয়ে অনেক শিক্ষার্থী নোট বই মুখস্থ করে। যা প্রায়োগিক জ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষক ও কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়ছে। শৈশবে পড়ালেখায় মনোযোগী না হওয়ার কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর অবস্থা আরো নাজুক। সেখানে মাতৃভাষা বাংলা পড়ার ক্ষেত্রে অনীহা থাকায় শিক্ষার্থীরা বাংলায় খারাপ করছে। মাদরাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের কথা আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। মাদরাসায় এবতেদায়ি শাখা দাখিলস্তরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পাঠদানে গাফিলতি রয়েছে। কুরআন হাদিসের প্রধান্য থাকায় মাদরাসায় জেনারেল বিষয়গুলোর গুরুত্ব কমে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা অনিয়মের খবর ভবিষ্যতের সংকট আরো ঘনীভূত করে তুলছে। গ্রামীণ এলাকায় যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা বিষয়ভিত্তিক সঠিক জ্ঞান লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। প্রশিক্ষণবিহীন অদক্ষ শিক্ষকও আমাদের নেহাত কম নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি না থাকায় তত্ত্বীয় ক্লাসের পরে আর ব্যবহারিক ক্লাস হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের নানা বিষয় হাতে কলমে শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া শিক্ষা উপকরণের অভাব ও অপ্রতুলতা, মানসম্পন্ন শ্রেণিকক্ষ, মাল্টিমিডিয়ার সুযোগ সমৃদ্ধ শ্রেণিকক্ষ ও গ্রন্থাগারের অপর্যাপ্ততা, দুর্বল ও গ্রামীণ অবকাঠামো, শিক্ষকদের স্বল্প বেতন ও পদমর্যাদা, অভাব- আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।
শিক্ষার সংকট তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। আমাদের সংবিধানে উল্লেখ আছে, শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। শিক্ষাকে কখনো পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়, এ রকম একটি চিন্তা আমাদের শিক্ষাদর্শনের ভিত্তি। কিন্তু যেদিন ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও পরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলো, কোচিং-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা পেলো, সেদিন থেকে শিক্ষা পণ্যের মোড়কে হাজির হতে থাকলো। এটি ঘটছে নানা কারণে, তার একটি হলো বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বে একটি বিশাল পণ্যসংস্কৃতি তৈরি হওয়া। এই পণ্যসংস্কৃতি অসম্ভব শক্তিশালী। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
শিক্ষাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষায় বাজেট বাড়াতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সংযোগ না থাকলে সে শিক্ষা ফলপ্রসূ হয় না। তাই শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সংযোগ ঘটাতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। স্কুল পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের যদি কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয় তাহলে এই বীরের জাতি অসাধ্যকে সাধন করে ফেলবে খুব সহজে। এজন্য প্রয়োজন যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, ব্যবহারিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ। তাহলেই তৈরি হবে শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি। আর শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্ত বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষকদের যোগ্য পদমর্যাদা দিয়ে আর্থিক সংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমায়োপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাস্তবমুখী কৌশল অবলম্বন করতে হবে। শিক্ষার সংকট এক দিনে দূর হবে না, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ যদি সংকল্পবদ্ধ হয় শিক্ষাকে সংকটমুক্ত করতে, তাহলে ওই পথে অনেক দূরই এগিয়ে যাওয়া যাবে। তারপর বিনিয়োগের প্রশ্নে সেই সংকল্পের প্রতিফলন ঘটলে শিক্ষার মান, ব্যাপ্তি ও গভীরতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাসমূহের সফল প্রতিবিধানের জন্য কয়েকটি বিষয় ও প্রস্তুতি অপরিহার্য। এর একটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকল্প ও সদিচ্ছা। শিক্ষাকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, পরিচালনা পর্ষদ ও রাজনৈতিক দলের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। জাতির শিক্ষা চিন্তায় শিক্ষাকে সর্বাগ্রে রাখা প্রধান্য দিতে হবে। পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির আধুনিকায়ন বিশ্বমানের করতে হবে। ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানসহ টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং উদ্ভাবনে অনেক পিছিয়ে। তাই শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হলে রাষ্ট্র, শিক্ষক অথবা শিক্ষার্থী প্রত্যেকেরই গবেষণাভিত্তিক শিক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষায় আনন্দের সংযোগ ঘটাতে হবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও কার্যকর কোনো শিক্ষানীতি কিংবা শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। করোনা মহামারি আমাদের শিক্ষাভিত্তিক সংকটকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলো। আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রকৃত জ্ঞান সৃষ্টি ও টিকে থাকাকে বাধাগ্রস্ত করছে। শৈশব থেকেই অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে থাকায় একসময় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া বিদ্যালয়ে শিক্ষার যথোপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে না। তাই এখনই সময় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবার। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কারিকুলাম প্রণয়ণ করে কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হবে। নতুন বিদ্যালয় স্থাপনের পাশাপাশি কারিগরি, মাদরাসা ও কওমি শিক্ষা নিয়েও ভাবতে হবে। সব ধরনের শিক্ষার মধ্যে একটা মৌলিক জ্ঞান রাখতে হবে। তবেই চলমান এ সংকট কিছুটা হলেও লাঘব হতে পারে।
লেখক: গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়