মানবিক কারণে হলেও শূন্য পদের বিপরীতে বদলি চালু করুন

মুহাম্মদ আলী, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

আমি মুহাম্মদ আলী। আমার কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরীতে। আমি এনটিআরসিএ’র তৃতীয় নিয়োগচক্রে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে বাড়ি থেকে সাতশো কিলোমিটার দূরে দুর্গম উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে এসে চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের একটি দাখিল মাদরাসায় শিক্ষকতা করছি।  এখানকার মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি সবই আমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে প্রায় সব মানুষই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। শিক্ষার্থীদেরও আঞ্চলিক ভাষা ছাড়া ভালোভাবে বোঝানো সম্ভব হয়না। এখানকার মানুষের মুখের ভাষা আমার কাছে বড়ই দুর্বোধ্য। আমার সহকর্মীরা যখন নিজেদের মধ্যে কথোপকথন করেন, তখন আমি বোঝার আশায় চরম উৎসাহ নিয়ে তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি শুধু। সিংহভাগ কথাই বুঝতে পারিনা। আবার স্থানীয় শিক্ষকরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পিরিয়ড নিতেও দূরের শিক্ষকদের বাধ্য করেন। এছাড়াও কোনো ক্ষেত্রে উনিশ বিশ হলেই হতে হয় নানাভাবে হেনস্থার শিকার। আমার চেয়ে বেশি শঙ্কা নারী শিক্ষকদের। নারী শিক্ষকরা যৌন হয়রানির শিকারও হচ্ছেন।   

আমার কর্মস্থল থেকে আমার একবার বাড়ি যাওয়া-আসায় সময় লাগে তিনদিন। যাতায়াত খরচ প্রায় ৫ হাজার টাকা। দুই একদিনের ছুটিতে ইচ্ছে থাকলেও বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয়না। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তার পাশে থাকতে পারিনা। এমনকি নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেলেও তার জানাজায়ও শরিক হতে পারিনা। 

বেতন তুলনামূলক অনেক কম হওয়ায় স্ত্রী সন্তানকেও কাছে রাখতে পারিনা। ফলে দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকে। সন্দ্বীপ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক ব্যয়বহুল জায়গা। ফলে যে বেতন পাই তা দিয়ে নিজে চলতে পারলেও পরিবারকে তেমন আর্থিক যোগান দেয়া সম্ভব হয়না। এ বছরের কোরবানির ইদের পর ছুটি শেষে যখন এখানে আসি তখন শিপঘাটে এসে জানতে পারি সাগরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত চলছে।  ফলে আমাকে ঘাটপাড়ে তিনদিন কাটিয়ে চতুর্থ দিনে সাগর উত্তাল থাকা সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপে আসতে হয়েছে।  একটি কাঠের ট্রলারে আমরা প্রায় দেড়শো জন যাত্রী ছিলাম। প্রায় সবাই কান্না করেছি। বিশেষ করে আমরা যারা সন্দ্বীপের বাইরের ছিলাম। বিশাল ঢেউয়ের তোরে নৌকা ডুবুডুবু।  এই দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করানো খুবই কঠিন। আমার ট্রাভেল ব্যাগের সব কাপড় ও আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সবই ভিজে যায়। তখন মনে মনে আল্লাহকে বলেছি, আল্লাহ তুমি আমাকে একবার সহি সালামতে আর একবার বাড়ি পৌঁছে দাও। আমি আর এখানে আসবো না। প্রয়োজনে চাকরিই ছেড়ে দেবো। 

আমি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আগে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। সেটি ছেড়ে দিয়ে এখানে যোগদান করেছি। এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সও শেষ। এই চাকরিটা ছেড়ে দিলে কী করে খাবো এই ভেবে চাকরিটাও ছাড়তে পারিনা। এটা ছেড়ে দিলে অন্য কোথাও চাকরি যে জুটবে, সেটাও অনিশ্চিত। এই চাকরিতে যোগদানের সময় ভেবেছিলাম পরবর্তী গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করে কাছাকাছি কোথাও চলে যেতে পারবো। কিন্তু পরবর্তী গণবিজ্ঞপ্তিগুলোতে আমাদের আবেদনের পথটাও রুদ্ধ করে দেয়া হয়। সে আশাটাও ধূলিসাৎ হয়ে যায় আমার।  প্রতিটা মুহূর্ত হীনমন্যতায় ভুগি। সত্যি সত্যিই মানসিকভাবে বড়ই বিপর্যস্ত।  সুষ্ঠুভাবে শ্রেণিকার্য সম্পন্ন করতে পারি না। এমতাবস্থায় বদলি নিয়ে নিজ এলাকা কিংবা কাছাকাছি কোথাও যেতে পারলে আমি মানসিক প্রশান্তি পাবো। মনে উৎফুল্লতা আসবে। আমার শিক্ষার্থীদের মাঝে সুষ্ঠুভাবে পাঠদান করতে পারবো। বদলি যদি চালু না হয় তাহলে চাকরিটা আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারবো বলে মনে হয়না।

শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিবসহ শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনায় অংশীজনদের নিকট প্রাণের আকুতি জানাই, অনুগ্রহ করে আমাদের শূন্য পদের বিপরীতে বদলি ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে আমার মতো ভুক্তভোগী শিক্ষকদের নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করুন। নির্জীব শিক্ষক থেকে সজীব শিক্ষক হতে সহায়তা করুন। কোনো ঠুনকো অজুহাতে আর দূরের শিক্ষকদের আধুনিক যুগের ক্রীতদাস করে উন্মুক্ত কারাগারে রাখবেন না। 
লেখক: সহকারী শিক্ষক 

লেখক : সহকারী শিক্ষক, পূর্ব সন্দ্বীপ ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম

(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন) 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031518936157227