শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। শিক্ষা মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে, দূর করে যাবতীয় কুসংস্কার। উন্নত জাতি বিনির্মাণে মানসম্পন্ন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা আদর্শ জাতি গঠনের প্রধান হাতিয়ার। মানসম্পন্ন শিক্ষাই দিতে পারে দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সক্ষমতা। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সকল নাগরিকই চায় মানসম্পন্ন শিক্ষা। কিন্তু প্রশ্ন হলো কে বা কারা দিবেন এই মানসম্পন্ন শিক্ষা? কারা তৈরি করবেন সেই সুশিক্ষিত জাতি, যারা দেশকে নিয়ে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়? এমন প্রশ্নের জবাবে হয়তো সকলেই বলবেন, ‘কেন? শিক্ষকরা’। হ্যাঁ। ঠিক তাই। মানসম্পন্ন পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষকরাই উন্নত জাতি গঠনে সহায়ক হবেন। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে শিক্ষক হচ্ছেন সেই মেরুদণ্ডের ভিত। জাতিকে উপযুক্ত শিক্ষাদানে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু এর জন্য চাই শিক্ষকের দুশ্চিন্তাহীন আনন্দমুখর সুস্থ মস্তিষ্ক। কেননা দুশ্চিন্তা নিয়ে কখনো সুষ্ঠু পাঠদান সম্ভব নয়।
কেউ কেউ বলবেন, শিক্ষকতা তো মহান ও মহৎ পেশা। এ পেশায় যথেষ্ট সম্মান আছে। তাহলে তাদের আবার দুশ্চিন্তা কীসের? আসলে মহৎ পেশার এই লোকদের কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না এমনটাই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবতা তার উল্টো। এই মহৎ পেশার লোকগুলোই আজ বেশি চিন্তিত। এরাই বেশি বঞ্চিত। কেননা শিক্ষকরা সমাজের অন্যান্য পেশার লোকদের সাথে কিছুতেই তাল মেলাতে পারছেন না। বিশ্বায়ন ও তথ্য প্রযুক্তির সাথে কোথাও খাপ খাওয়াতে পারছেন না নিজেদের। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এ পেশার লোকদের নামে মাত্র যে মাইনে দেয়া হয় তা দিয়ে দুইবেলা পেটের খাবারই ঠিকমত জোটে না। একজন শিক্ষক হিসেবে বাজারে গিয়ে তাকে খুঁজতে হয় সবচেয়ে কমদামের জিনিসটি। মাছ মাংস যেন তাঁদের জন্য এক দুঃস্বপ্নের মত। বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তানের মুখে দুবেলা আহার তুলে দেয়া ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হয় প্রতিনিয়ত। খরচ যোগাতে না পেরে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারেন না সন্তানকে। কারো চাহিদাই ঠিকমত পূরণ করতে না পারায় সবার কাছেই তিনি পান বঞ্চনা। এ তো গেল, যারা নিজ বাড়িতে থেকে বাড়ির পাশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক তাদের কথা।
শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশের ক্ষমতা কমিটির হাত থেকে এনটিআরসিএর কাছে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত তিনটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করেছে। এনটিআরসিএর কাছে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর দেশের এক জেলার শিক্ষক অন্য জেলায় গিয়ে শিক্ষকতা করছেন। বাড়ি থেকে ১০০ থেকে ৯০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে গিয়ে শিক্ষকতা করছেন। কেউ কেউ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল কিংবা আমার মত দুর্গম সাগর পাড়ি দিয়ে দ্বীপাঞ্চলে শিক্ষকতা করছেন। তাদের কষ্ট আর বুকফাটা আর্তনাদের কথা বলে প্রকাশ করার মত নয়। একজন সহকারী শিক্ষকের এন্ট্রি লেভেলের বেতন মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা, ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা মিলে মোট বেতন দাঁড়ায় ১৪ হাজার টাকা। মূল বেতনের ১০ শতাংশ কর্তনের পর সর্বসাকুল্য প্রাপ্য বেতন ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। এ টাকা দিয়ে এতদূরে থাকা খাওয়া শুধু কষ্টেরই না। খানিকটা অসম্ভবও। আপনি বিশ্বাস করুন বা নেই করুন, এখন এক হাজার টাকায় বস্তির জীর্ণশীর্ণ ছোট একটি ঝুপড়ি ঘরও ভাড়া পাওয়া যায় না।
তাই এরকম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শিক্ষক দ্বারা বিশ্বমানের মানসম্মত পাঠদান সম্ভব নয়। মানসম্মত পাঠদানের মাধ্যমে উন্নত জাতি গঠন করতে হলে শিক্ষকদের দিতে হবে স্বাচ্ছন্দ্য। আর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য শিক্ষকদের করতে হবে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। সেই সাথে দূরবর্তী শিক্ষকদের বাড়ির কাছে করতে হবে বদলি।
আবেগী বাঙালি প্রিয়জনের মুখ দেখে ও কাছে থেকে অনেক অভাব ভুলে থাকতে পারেন। সুতরাং উন্নত জাতি গঠনের জন্য মানসম্মত পাঠদানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলিটাই সবার আগে প্রয়োজন।
লেখক: মুহাম্মদ আলী, এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক, মগধরা, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম