আমার প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস আজ উত্তাল। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। তারা শ্লোগান দিচ্ছেন, ‘ক্যাম্পাসে ধর্ষক কেনো, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘ধর্ষণমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’, ‘ধর্ষকদের পাহারাদার, হুঁশিয়ার সাবধান’ ইত্যাদি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে, ধর্ষকদের নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তবে ওই ঘটনায় জড়িত সবাইকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বাতাস কোনদিকে যাচ্ছে দেখে দুর্বল দুএকটা পদক্ষেপ নিয়েছে। শেষ অবধি তারা হয়তো বাতাস যে দিকে শক্তিশালী সেদিকেই তাল মেলাবে, সেটি বৈধ হোক বা অবৈধ। পরিস্থিতি উত্তাল না হলে প্রশাসন হয়তো ধর্ষকদের সাময়িক বরখাস্ত করেই ক্ষ্যান্ত দিতো। তবে এখনো গ্রেফতারকৃতদের পক্ষে বা তাদের মুক্তির দাবিতে কোনো মিছিল বের হয়নি। এটা নি:সন্দেহে ইতিবাচক দিক।
আমাদের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে কালচার তৈরি হয়েছে সেটি হচ্ছে অপরাধকে অপরাধ না বলে, অপরাধীকে অপরাধী না বলে দলগত কালার দেয়া। এটি চলে এসেছে বহুদিন ধরেই। আর এ বিষয়টি তো আমরা সব সময়ই লক্ষ্য করেছি যে, ক্যাম্পাসে ছোট ছোট দলগুলোর নেতাকর্মীদের সুন্দরবনের হরিণের মতো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হয়। তাই তাদের সচরাচর এমন কর্মে লিপ্ত হতে হয় না। এ ধরনের অপকর্মে শক্তিশালী সংগঠনের সদস্যরাই এগিয়ে থাকেন। কারণ, তাদের ক্ষমতা আছে। ক্ষমতার সঙ্গে ধর্ষণের একটি সম্পর্ক আছে। আর প্রশাসনও তাদের তোয়াজ করে চলে। তো এ ধরনের কর্মকাণ্ড মাঝে মধ্যে দু’একটি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ভয়কে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসেন। প্রশাসনকেও দেখা যায়, দু’ চারটে কথা বলতে এবং দুর্বল দু’একটা পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু, এগুলো তো কোনো সমাধান নয়!
জাহাঙ্গীরনগরের সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে খুব কঠিন করে কোনো সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় এখনো দেখতে পাইনি, তবে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা যেসব কথা বলছেন বিভিন্ন পত্রিকা সেগুলো তুলে ধরছে। ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের আহবায়ক আলিফ মাহমুদ বলেছেন, এই হলেই শাহ পরান আছে। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। এভাবেই ধর্ষকরা ক্রমাগত বেঁছে যাচ্ছে প্রশাসনের ছাত্রছায়ায়। মূলত প্রশাসনের উদাসীনতাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকের চেয়ারে বসা কিছু নরাধমের নিকট জিম্মি হয়ে আছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্রী মনিকা ইয়াসমিন বলেন, ধর্ষকের মাথার ওপর কার হাত আছে তাকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন। সমূলে ধর্ষণকে নির্মূল করতে হবে।
নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র কনোজ কান্তি রায় বলেন, ১৯৯৮তে ধর্ষণ করেছে মানিক, আজকে করছে তার উত্তসূরীরা। প্রক্টর ধর্ষকদের পালাতে সাহায্য করেছেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন মানিক শতাধিক নারীকে ধর্ষণ করে তা উদযাপন করেছিলো। কতবড় লজ্জাকর এবং অমানবিক ও পৈশাচিক কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনে! কিন্তু সবকিছু দেখে মনে হয়েছিলো, তেমন কিছুই যেনো হয়নি। এ জন্য তার নাম হয়েছিলো ‘সেঞ্চুরি মানিক’। আমার প্রিয় জাবি কি কখনো এমন মানিক ও তার উত্তরসুরীদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে?
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের নেতারা হলের ভিআইপি। অপরাধীর অভয়স্থল হচ্ছে এসব রুম। তারা একেকজন সিঙ্গেল রুম বা একাধিক রুম নিয়ে থাকেন। হলের বিভিন্ন ইস্যুতে তারাই প্রশাসনের সঙ্গে মিটিং করে বা প্রশাসক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তাদের আসলে হলেই থাকার কথা নয়। প্রশাসন এসবে কখনো নীরব দর্শক বা আসকারাদানকারী।’
ক্যাম্পাসে নাকি এখন প্রায় আড়াই হাজার অছাত্র রয়েছেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে অছাত্র বা যারা মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছেন তাদের থাকার কথা নয়। সেখানে আড়াই হাজার অছাত্র অবস্থান করছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীস অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতারা বলছেন, প্রশাসনের সহায়তায়ই তারা থাকছেন। সাধারণ শিক্ষার্থী, নিপীড়িত ও নিরীহ শিক্ষার্থীসহ অন্য সবাই কিন্তু প্রশাসনকেই দোষ দিচ্ছেন এবং এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটি চর দখল নয়, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এখানকার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনে যারা আছেন তারা যে পার্টিকেই সমর্থন করুন না সবাই উচ্চতর শিক্ষিত, বড় বড় গবেষক এবং অত্যন্ত মেধাবী। তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্র অবশ্যই নিরপেক্ষতাসহ শিক্ষার উন্নয়নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ আশা করে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসির কথা জানি (ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী)। তিনি কিন্তু রাষ্ট্রকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের অনুসারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। তাদেরকে এখান থেকে নিয়ে যান।’
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান প্রশাসন যদি রাষ্ট্রকে জানায় যে, ক্যাম্পাসে কোনো অছাত্র থাকতে পারবে না, বিশ্ববিদ্যালয় হবে জ্ঞান ও গবেষণার আগার। এখানে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও পড়তে আসবে। আমরা রাষ্ট্রকে সে ধরনের ক্যাম্পাস উপহার দিতে চাই। নিশ্চয়ই রাষ্ট্র তাতে সাড়া দেবে। কিন্তু সে ধরনের কোনো প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে দেখছি না। দু’একটা ঘটনা যখন সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় আকার ধারণ করে তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে কথা শিক্ষার্থীসহ সচেতন মহলের কাছে কোনো মূল্য বহন করেনা। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। অন্যায়কে অনেকেই সহযোগিতা করতে পারে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনোভাবেই নন। তারা জাতির বিবেক।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।