মারি ত গণ্ডার, লুটি ত ভাণ্ডার

বোরহানুল হক সম্রাট প্ল্যানিং এডিটর দৈনিক আমাদের বার্তা |

‘মডেল অব লুটিং।’ এই নাম কোনো সিনেমার পরিচালকের দেয়া নয়, দেশের বিদ্যুৎখাত পরিচালনায় কেন্দ্রগুলোর সাথে যে প্রক্রিয়ায় ব্যবসাটা করা হয়, গণমাধ্যমের খবর, সরকারের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ আইএমইডি সেই মডেলকে লুটেরা বলছে। দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জকে ‘মডেল অব লুটিং (লুটেরা মডেল)’ আখ্যা দিয়ে আইএমইডি’র ওয়েব সাইটে থাকা গত জুন মাসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গত ১৪ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার ‘গচ্চা’। যদিও আইএমআইডি এ লুটেরা মডেল বিষয়ক গণমাধ্যমের খবর-এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে এবং তাদের ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনে ওই অংশটুকু প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তারা বলছে, ক্যাপাসিটি চার্জ সংক্রান্ত মন্তব্যটি একটি প্রবন্ধের মতামত যা কীভাবে তাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়েছে, তা খুঁজে বের করার উদ্যেগ নেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়, সেটারই আনুষ্ঠানিক নাম ক্যাপাসিটি চার্জ। কেন্দ্র যত বেশি বসে থাকে ক্যাপাসিটি তত বেশি চার্জ হয়। যেমন ধরুন, এই মুহূর্তে দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৩টি, যেগুলোর সক্ষমতা ২৭ হাজার ৪৮১ মেগাওয়াট। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৫০০। গত শনিবারের বিদ্যুৎ চাহিদার পূর্বাভাস ছিলো ১৩ হাজার ১শ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ১২ হাজার থেকে গড় উৎপাদন সাড়ে ১৪ হাজার, একদিন সম্ভব হয়েছিল ১৫ হাজার ৬৪৮ করার। ফলে যা ক্ষমতা তার অর্ধেক কেন্দ্র বসে থাকে। এটাই ভুল। আসলে বসে থাকে না। বন্ধ থাকলেই সেখানে চালু হয় ওই ক্যাপাসিটি চার্জের এক ধরনের মেশিন! যার বেশির ভাগ মালিকানার চাবি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতেই থাকে। বিদ্যুৎ না লাগলেও এতো কেন্দ্র করে করে বেসরকারি ব্যক্তির টাকা নিয়ে যাওয়াটাকেই আইএমআইডি বলছে লুটেরা মডেল। তাহলে সরকার না চাইলে কী ইচ্ছেমতো বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যায়? এর উত্তর হচ্ছে, না। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেশে এ মুহূর্তে আরো প্রায় ১৩ হাজার ১০৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ছোট বড় অসংখ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে এবং নতুন করে আরো প্রায় ২ হাজার ৫৭৭ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরের আয়োজন চলছে। এসব কেন্দ্র যোগ হলে আর মাত্র ৪ বছর পর ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়াবে ৩৭ হাজার ৩৯০ মেগাওয়াট। ফলে যদি প্রকৃত চাহিদা বেড়ে ২০ হাজার মেগাওয়াটও হয় তারপরও বসে থাকবে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

আর এই বসে থেকে টাকা কামানোর নাম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের মুল্যায়ন বিভাগ দিয়েছে, ‘মডেল অব লুটেরা’। কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পিডিবিকে লোকসান গুনতে হবে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। এর আগের ১২ বছরে সংস্থাটি লোকসান গুনেছে ১ লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার মোট যা লোকসান করেছে, তার চেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে গত দুই অর্থবছরে। কারণ হলো- এই দুই বছরে একদিকে উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে অচল কেন্দ্র বসে থাকার পরিসংখ্যান।

সরকারি প্রতিবেদন-ই বলছে, দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে আছে তেল ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো, যার ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের সরবরাহ করতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়। অন্যদিকে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জসহ যোগ করলে দেখা যায়, কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি বার্ষিক গড় মূল্য ১০০ টাকাও ছাড়িয়ে গেছে। যার অভিঘাত পড়ছে সাধারণ মানুষের পকেটে, সংসারে। ফলে আর কেউ নয়, আইএমইডি মনে করে এই দুর্বৃত্তায়ন থামানো জরুরি।

তবে আইএমইডির এমন প্রতিবেদনের ঠিক ৪ বছর আগে এক বিশ্লেষণ জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনোমিকস ফাইনান্সিয়াল অ্যানালিসিস আইইইএফএ। ২০১৯ এর মে মাসে দেয়া এক প্রতিবেদনে তারা দাবি করেছিল, বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি স্থাপন করা হয়েছে। সে কারণে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের ওপর ‘বাংলাদেশ পাওয়ার রিভিউ ওভার ক্যাপাসিটি, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট, সাবসিডিজ অ্যান্ড ট্যারিফ আর সেট টু রাইজ ইভেন ফাস্টার’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের পঞ্চাশ শতাংশ অলস বসে থাকছে। এসব অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা কেন্দ্র ভাড়ার কারণেই বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। আইইইএফএ জানায়, বর্তমানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি নির্ভর যে বিদ্যুৎ সেক্টর গড়ে উঠছে তা বাংলাদেশের জ্বালানির আর্থিক সক্ষমতা তলানিতে নিয়ে যাবে। 

ওই গবেষণার প্রধান বিশ্লেষক সাইমন নিকোলাস শঙ্কা জানিয়ে বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও কমে যাবে এবং ২০২৯-৩০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ চাহিদা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক কম হবে। এতে অলস বসে থাকা শতকরা ৫৮ ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্থনীতির জন্য অসহনীয় হয়ে উঠবে।
আইইইএফএ’র প্রতিবেদন নিশ্চয় খেয়াল করেছে দেশীয়  আইএমইডি। আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, ক্যাপাসিটি চার্জের বর্তমান মডেল কোনোভাবেই টেকসই নয়। ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ আসবে না- এমন দাবিও মিথ্যা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে স্থান ভেদে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রির সুবিধা রাখা এবং সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে এক-চতুর্থাংশ বা অর্ধেক বিদ্যুৎ কেনার নিশ্চয়তা দেবে- এ দুটি শর্তই যথেষ্ট; সঙ্গে সহজ শর্তে ব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তির বিষয়টিও থাকবে।

অভিযোগ আছে, এ খাতের কিছু মানুষ সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে ভুল বুঝিয়ে ‘২০১০ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি’ নামে বিশেষ আইন করে। আইনটি দায়মুক্তি আইন নামেই বেশি পরিচিত। আইএমইডির ওয়েবসাইটে থাকা আলোচিত ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এ আইন বিদ্যুৎ খাতে লোকসান বয়ে আনছে। দায়মুক্তির সুযোগ দেয়া এ আইনের বলে বিদ্যুৎ খাতের ইউনিটপ্রতি ক্রয়মূল্য ও খরচের মডেল জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। আইএমইডির ওয়েবসাইটের ওই অংশে বলা হয়েছে, কারিগরি জ্ঞানহীন ও অভিজ্ঞতাহীন একদল দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাপক ভুল ও অদূরদর্শী সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা এবং আইনি প্রক্রিয়ার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে অযোগ্য করে রেখেছে; যার বিনিময়ে তা ভিন্ন দুটি দেশের সরবরাহকারীদের পুনর্বাসনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। 

শেষ করবো আইন প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের প্রফেসর সুকান্ত চৌধুরীর বক্তব্য দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘আইনি ভাষা সঙ্গত কারণে দুরূহ হয়, এ ক্ষেত্রে হওয়াটা অকারণ ও অমার্জনীয়। জু়ড়ে দিয়েছেন এই টিপ্পনী, জীবনভর ইংরেজির শিক্ষক তিনি ‘হিমশিম’ খেয়েছেন এই ড্রাফট পড়তে গিয়ে। ন্যায্য কথা! কেন এত দুরূহ? কারণ, সহজে এইসব সর্বনেশে কথা লিখে দেওয়া যাবে না।’’

সরকারের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই দুরূহ আইন নয়, আইএমইডির ওয়েব সাইটে কিছু সময়ের জন্য হলেও টিকে থাকা প্রথম প্রতিবেদনের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ (৫.২) বা ভিন্ন নামের অনুসন্ধানী প্রবন্ধকে আমলে নেবেন। কথাগুলো যদি সত্য হয়, সে অনুযায়ি ব্যবস্থা নিয়ে এ খাতকে পরিশুদ্ধ করবেন। কারণ আর কে বললে বিশ্বাস হতে পারে যে, অনিয়ম আর অনাচারে সত্যিই ৯০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে? 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ - dainik shiksha ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস - dainik shiksha এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047080516815186