মার্কিন শিক্ষার্থীরা গাজার জন্য লড়ছে কেন?

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণবিক্ষোভকে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর ও বিভ্রান্তিকর আলোচনা বলে খাটো করে দেখা যাবে না। ইহুদিদের প্রতি কিছু মজ্জাগত ঘৃণার কারণে দেশজুড়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, এমন কিন্তু নয়। কিংবা এ কারণে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তার ঝুঁকি নিচ্ছে না; বরং গাজায় অরক্ষিত ফিলিস্তিনবাসীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি রাষ্ট্র যে গণহত্যা সংঘটিত করছে, তা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করায় বৈধ ক্ষোভ হিসেবে তারা এই বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে।

গত ৭ অক্টোবর গাজা রক্তে ভেসে যেতে শুরু করে, যা পুরোপুরি মার্কিন সরকারের তহবিল ও সমর্থনে ঘটেছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। গত ১৭ এপ্রিল কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, যদিও বর্তমানে তা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে টেক্সাস ও উত্তর ক্যারোলাইনা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। 

কর্মসূচির ধরন ও মাত্রার দিক থেকে এসব আন্দোলনকে ষাট ও সত্তর দশকে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো যে যুদ্ধ, তার বিরোধী বিক্ষোভ হিসেবে তুলনা করা হচ্ছে। এই তুলনা উপযুক্ত হলেও চলমান বিক্ষোভে জাতিগত বৈচিত্র্য ও সামজিকভাবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি খেয়াল করা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষাঙ্গনে আরব, মুসলিম, ইহুদি, কৃষ্ণাঙ্গ, আদি আমেরিকান বা নেটিভ আমেরিকান ও শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরা যুদ্ধবিরোধী সংহতি জানিয়ে ফিলিস্তিনি সহপাঠীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে।  

গাজায় যুদ্ধ করতে তাদের তালিকাভুক্ত করা হতে পারে– এই আতঙ্কে কেউই উৎসাহিত নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় অনেক মার্কিন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এ ধরনের নজির রয়েছে। এটি সত্ত্বেও তারা কিছু স্পষ্ট অভীষ্ট সামনে রেখে সংঘবদ্ধ হয়েছে। সেগুলো হলো– যুদ্ধ ও ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন বন্ধ করে দেওয়া; ইসরায়েলে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সরাসরি বিনিয়োগ বন্ধ এবং তাদের আন্দোলন করার অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া। এটি কোনো ভাববাদ নয়, বরং মানবতার সবচেয়ে সুন্দর মূহূর্ত।  

কলাম্বিয়ায় গণগ্রেপ্তার শুরু হওয়া ও সর্বত্র শান্তিপূর্ণ মিছিলে সরাসরি সহিংসতা চালানোর পর আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে জো বাইডেন থেকে শুরু করে মার্কিন রাজনীতিবিদরা আন্দোলনকারীদের যুক্তিসম্মত ও বৈশ্বিক সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে দাবিগুলো বিবেচনায় না নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষী বলে অভিযোগ এনেছিলেন।

আবারও বলা দরকার, ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকানরা একসঙ্গে অন্ধভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েছে। বাইডেন ‘কলঙ্কজনক ও বিপজ্জনক’ আখ্যা দিয়ে ‘ইহুদিবিরোধী বিক্ষোভ’-এর নিন্দা জানিয়েছিলেন। কয়েক দিন পর মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন কড়া নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছিলেন। এ সময় তিনি এমন ভাষা ব্যবহার করেছেন, যা গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকার বরণ করে নেওয়ার দাবি করে এমন একটি দেশের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন। মাইক বলেছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে আমরা এ ধরনের ঘৃণা ও ইহুদি-বিরোধিতাকে উস্কে দিতে পারি না।’ তিনি এও বলেন, ‘আজ আমি এখানে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে যোগদান এবং প্রেসিডেন্ট শফিক (মিনৌসিকে) যদি বিশৃঙ্খল অবস্থায় তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে না পারেন, তাহলে তাঁকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানাতে এসেছি।’ ইতোমধ্যে শফিক বোর্ডে ছিলেন। তিনি তাদের মধ্যে একজন, যারা ভুলবশত আন্দোলনকারীদের ইহুদিবিরোধী বলে অভিযোগ এনে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগকে ডাক দিয়েছিলেন। 

আন্দোলনের কারণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির মিডিয়া ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছিল। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে একাধিকবার স্টিভেন স্টালিন্সকির মতো লেখকদের জায়গা দেওয়া হয়েছিল, যিনি গাজায় ইসরায়েলি ভয়াবহ গণহত্যার সমালোচনা করতে সাহস দেখানোর কারণে তরুণ বিচারপ্রার্থী কর্মীদের চিনে রাখতে বলেছিলেন। তিনি অভিযোগ তুলেছিলেন, ‘হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও অন্যরা যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যজুড়ে কর্মী তৈরি করছে।’ এরই মধ্য দিয়ে তিনি গণহত্যায় মার্কিন সমর্থনের ব্যাপারটি অদ্ভুত ও অপ্রমাণিত বলে জোরালো বক্তব্য হাজির করেন। হয়তো মার্কিন এস্টাবলিশমেন্টের লেখকরা নিজেদের ও তাদের পাঠকদের বোকা বানিয়ে রেখে দিতে চান। কিন্তু যা সত্য, হিজবুল্লাহ কিংবা হামাস ‘রিক্রুটারস’ কেউই আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সক্রিয় নয়; যেখানে তরুণদের সরকার ও বড় বড় করপোরেশনে নেতৃত্ব দিতে গড়ে তোলা হয়।  

এসব বিভ্রান্তির অর্থ হলো, মার্কিন সমাজে অবশ্যম্ভাবী রূপান্তরকে অস্বীকার করা, যা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে তাদের মনোভাবে দীর্ঘদিনের পরিবর্তন নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়। চলমান যুদ্ধের আগে বছরের পর বছর তেল আবিবের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ নিয়ে আমেরিকাবাসী তাদের মতামতে পরিবর্তন আনছে। তরুণ ডেমোক্র্যাটরা এ ধারায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের স্বাধীন বলেও মনে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে তরুণ রিপাবলিকানরাও যুক্ত। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলিদের চেয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি বেশি জোরালো।’ এ পরিস্থিতি অতীতে কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু এটিই নতুন করে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ জরিপগুলোতে বাইডেনের হ্রাসমান রেটিংয়ের সঙ্গে বিষয়টি এভাবেই প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেছে।   

মার্কিন রাজনীতিবিদদের পুরোনো প্রজন্মের সুগঠিত ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছে শর্তহীনভাবে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন দিয়ে। তারা নতুন বাস্তবতা দেখে অভিভূত। তাদের ভাষা বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যায় ধাঁধাযুক্ত। এর পরও তারা ইসরায়েলি সরকারের দাবি পূরণ করতে নিজেদের লোকদের পুরো প্রজন্ম তথা আমেরিকার ভবিষ্যৎ নেতাদের অসম্মান করতে ইচ্ছুক।  

লাখ লাখ আমেরিকান যুদ্ধ, অন্য একটি দেশের প্রতি সরকারের বাধ্যবাধকতা, সামরিকতন্ত্র, পুলিশি সহিংসতা, যুক্তরাষ্ট্রে অভাবনীয় বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ইত্যাদি নিয়ে স্পষ্টত হতাশ। নিজেদের স্বার্থ অথবা আগের প্রজন্মের ঐতিহাসিক কিংবা আধ্যাত্মিক বিভ্রম দ্বারা তাড়িত নয় এমন আমেরিকান তরুণরা ঘোষণা দিচ্ছে– ‘আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে।’ তারা স্লোগান দেওয়া, সংহতি প্রকাশ, দাবি জানানো, নৈতিক ও আইনগতভাবে দায়বদ্ধতা ও যুদ্ধ তৎক্ষণাৎ বন্ধের দাবি জানানোর চেয়ে বেশি কিছু করছে। এখনও মার্কিন সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং তারা লাখ লাখ ফিলিস্তিনির বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাতে ইসরায়েলি যুদ্ধ মেশিনকে তেল দিয়ে যাচ্ছে। এই সাহসী শিক্ষার্থীরা এসবের বিরুদ্ধে লড়ছে। নিশ্চিতভাবে এটি বেশ উৎসাহ-জাগানিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। 

রামজি বারুদ: দ্য প্যালেস্টাইন ক্রনিকলসের সম্পাদক; সংক্ষেপিত ভাষান্তর 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ - dainik shiksha শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045688152313232