মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রির মূল্য

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

হাসবেন না। আমাদের গতানুগতিক চিন্তাধারায় পিএইচডি, মাস্টার্স বা যে কোনো ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তুললে হাসি ঠেকিয়ে রাখা অবশ্যই কষ্টকর। তবে পিএইচডি ও মাস্টার্স ডিগ্রির কোনো মূল্য নেই বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন আফগানিস্তানের নতুন শিক্ষামন্ত্রী। আমি যতটা বুঝেছি, তিনি তালেবানের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে এ কথা বলেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন- তালেবানের প্রাথমিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও তার মতে, তারাই শ্রেষ্ঠ। বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, এই শ্রেষ্ঠত্বের প্রসঙ্গটি আজ আমরা এড়িয়ে যাই। বরং শিক্ষা বা ডিগ্রির মূল্য নিয়ে কিছু চিন্তা করি। মন্ত্রীর 'মূল্য' শব্দটি আমাদের সবার জীবনে কোনো অর্থ বহন করে কিনা তা একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখি। ডিগ্রি মানবজীবনে কী দেয় আর কী কেড়ে নেয়, তাও আমরা ভাবব।

হ্যাঁ, ডিগ্রি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আফগান মন্ত্রী আসলে ভুল বলেছেন। ডিগ্রি না থাকলে কে কতটা শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বা কে কোন বিষয়ে শিক্ষা নিয়েছেন তা যাচাই করা সম্ভব নয়। ডিগ্রি হচ্ছে পড়ালেখা করার স্বীকৃতি। এ সময় আমাদের স্বীকৃতিপত্রও দেওয়া হয়, যা চাকরি বা অন্যান্য কাজ পেতে সাহায্য করে। আরও শিক্ষা গ্রহণের কাজেও প্রয়োজন হয়। স্বীকৃতি বা ডিগ্রি আমাদের পড়াশোনা করতে প্রেরণা জোগায়।

তাহলে ডিগ্রি ব্যবস্থা না থাকলে কি আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতাম না? আসুন স্বীকৃতিহীন এক পরিস্থিতির কথা একটু চিন্তা করি। ধরুন, সারা বিশ্বে কোনো বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তবে লেখকরা পুস্তক লেখেন এবং আমরা তা পড়ে নিজ নিজ কাজ করি। চাকরিও পাওয়া যায়। তাহলে কি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন? শিক্ষার স্বীকৃতি প্রয়োজন? জটিল এক চিন্তা। এখন যেমন করে জীবন চলে, হয়তো তেমন নয় তবে অন্যভাবে অবশ্যই চলত।

সক্রেটিসের যুগেও মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য করত, চাকরিও করত। কিন্তু 'ব্যবসায় প্রশাসন' নামে কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করে তাদের এসব করতে হয়নি। ইতিহাসে অনেক নবীর কথা বলা আছে, যারা পড়তে পারতেন না। আমাদের লালন, হাছন বা করিম কোনো বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই। কবি নজরুলের কথাই ধরুন। তিনি কোন শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন? সক্রেটিস, প্লেটো বা অ্যারিস্টটল- তাদের ডিগ্রি কে দিত? প্লেটো অবশ্য তার গুরুর মৃত্যুর পর গুরুর নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।

কয়েক শতক আগে যারা দেশ শাসন করতেন, তারা নিশ্চয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে তাদের কাজ করেননি। তখন যদি এখনকার মতো বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয় থাকত তাহলে হয়তো তারা ডিগ্রি নিতেন। কিন্তু তখন প্রয়োজন হয়নি। তারা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন এবং তাদের পরিষদেও অনেক স্বশিক্ষিত মানুষ থাকতেন, যারা তাদের পরামর্শ দিতেন।

সাধারণ মানুষ তাহলে কী করত? তারা কোথায় অক্ষরজ্ঞান অর্জন করত? কয়েক দশক আগেও আমাদের দেশে অক্ষরজ্ঞানের তেমন প্রয়োজন ছিল না। জীবন চলত, তবে আমরা অনেক গরিব ছিলাম। শিক্ষা গ্রহণ শুরুর পর থেকে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির শুরু, নতুন চিন্তার অগ্রগতির শুরু। তখন উন্নয়ন এক রকম ছিল, এখন তার ধারা অন্য রকম। অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ভেবেই বর্তমান শিক্ষা গ্রহণের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

আমার দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল একশ বছর আগে। বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু তারও আগে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা ডিগ্রি নিয়েছেন, তাদের সংখ্যা কত হতে পারে? ঠিক জানি না। তবে অনেক লাখ হবে। দেশে আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। সেখান থেকেও লাখ লাখ মানুষ ডিগ্রি নিয়েছেন। অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি ইত্যাদি। দেশে চিকিৎসাশাস্ত্র শেখার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান আছে এবং হাজারো বাঙালি সেখানে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হয়েছেন। এখানে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি শিক্ষা বিদ্যালয় অনেক। ডিগ্রি গ্রহণেচ্ছু মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। গত ৩০ বছরে ইতিহাস বলে, বর্তমানে এ দেশে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ডিগ্রি হচ্ছে 'ব্যবসায় প্রশাসন' বিষয়ে। 'ব্যবস্থাপনা'ও একটি সমাদৃত বিষয়। আমরা খুব ইংরেজি শিখতে চাই এবং ১২ বছর ধরে কলেজ পাস সবাই ইংরেজি শেখেন। এখানে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে ডিগ্রি নেওয়ার জন্য বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় আছে। বাংলাদেশে ধর্ম ও আরবি ভাষা বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়ার জন্য সারাদেশ মাদ্রাসা-মক্তবে ছেয়ে আছে।

ডিগ্রি এখন বাজারে কিনতেও পাওয়া যাচ্ছে। বাঁচতে চাইলে ডিগ্রি প্রয়োজন; অর্থ উপার্জন করতে চাইলে .িডগ্রির বিকল্প নেই।

গাছ দেখতে সুন্দর, কিন্তু অনেক বেশি গাছ থাকলে তা একটা জঙ্গল হয়ে যায়। ডিগ্রিগুলো আমাদের এখানে তাই-ই হচ্ছে কিনা একটু ভাবতে সবাইকে অনুরোধ জানাই।

এবার আসল কথায় আসি। অবশ্য আমার 'আসল' আপনার কাছে 'আসল' নাও হতে পারে। তবুও বলি, যে ডিগ্রির মাধ্যমে আমরা শিক্ষিত হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছি, তা আমায় প্রজ্ঞার কোন স্তরে পৌঁছে দিতে পারছে? ডিগ্রির সাহায্যে নিজের ভেতরে কতদূর দেখতে পাচ্ছি? এই ডিগ্রি আমাকে কতটা মানবিক হতে সাহায্য করছে?

আমার নিজের কথাই বলি। আমি ডিগ্রিধারী হয়েছি ক্যাডেট কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। আমার ডিগ্রি সাধনের পেছনে যাদের আর্থিক অবদান আছে তাদের উন্নয়নের জন্য আমি ডিগ্রিকে কতটা কাজে লাগাতে পারছি? তাদের উন্নয়নে নিজেকে কিছুটা হলেও নিয়োজিত করতে চাচ্ছি কিনা?

যে পৃথিবীর প্রকৃতি মানব জাতির সব ক্ষুধা মেটাচ্ছে, তা রক্ষার জ্ঞান ও ইচ্ছা কি আমার ভেতরে তৈরি হচ্ছে? সমাজে বা মানুষে-মানুষে ভারসাম্য অথবা সমতা বজায় রাখার মানসিকতা স্ম্ফীত করতে এই ডিগ্রিগুলো আমাকে কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? এই ডিগ্রিধারী আমিই তো অন্যের অর্থ চুরি করি, নদী দখল করি, খাবার নষ্ট করি, মতের মিল না হলে খুন পর্যন্ত করি।

তাহলে দিন শেষে ডিগ্রিগুলোর অর্থ কী দাঁড়ায়- এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি জানতে চাই। উত্তরগুলো না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত আমরা পরিণত সমাজ তৈরি করতে পারব বলে মনে হয় না। যারা ডিগ্রিকে ব্যবহার করেন অন্যকে শোষণ করার জন্য, তারা চেতন মনে আপাত-সুখী মনে হলেও অবচেতন মনে অতি অসুখী। আমার গাড়ির কাচের বাইরে থালা হাতে একজন দাঁড়িয়ে অর্থ ভিক্ষা করবে আর আমি শীতাতপের ভেতরে বসে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব- এ পরিস্থিতি কোনো ডিগ্রিসুখের লক্ষণ হতে পারে না।

লেখক : গল্পকার,ইকরাম কবীর, যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023970603942871