জাতি হিসেবে বাঙালির সবচেয়ে গর্বের, সবচেয়ে অহংকারের বিষয় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। আমরা পাই একটি স্বাধীন পতাকা, একটি স্বাধীন মানচিত্র। বিশ্বের বুকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতি। আর যার জন্য এই মর্যাদা, তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত একটা জাতিকে সুসংগঠিত করে ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দেন। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর ইঙ্গিত পেয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। আনুষ্ঠানিক ও চূড়ান্ত ডাক আসে ২৬ মার্চ। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর পাকিস্তানি হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। ধীরে ধীরে সারাদেশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কতিপয় স্বাধীনতা বিরোধী ছাড়া সারা দেশের মানুষই কোনো না কোনোভাবে মুক্তি যুদ্ধে আবদান রাখে। কেউ সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে, কেউ লিখে, কেউবা গান করে, কেউ দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে জনমত গঠন করে, কেউবা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে নানাভাবে অবদান রেখেছে। ঠিক একইভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে খুলনা জেলার মানুষেরও রয়েছে গৌরবোজ্জল অবদান।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকবাহিনীর বর্বর সেনারা খুলনা ও তার আশে পাশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। গণহত্যার জায়গাগুলো বধ্যভূমি হিসেবে এখনো কালের স্বাক্ষী। যে সব জায়গায় তারা গণহত্যা চালায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-গল্লামারী বধ্যভূমি, ফরেস্ট ঘাট, চুকনগর গণহত্যা, বাদাম তলা গণহত্যা, দেয়াড়া গণহত্যা, ডাকরা গণহত্যা, শাঁখারি কাঠির গণহত্যা, ঝাউডাঙ্গা গণহত্যা প্রভৃতি (তথ্য সূত্রঃ বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-গৌরাঙ্গ নন্দী )।
ধীরে ধীরে খুলনা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। খুলনা জেলার বৃহৎ অংশ ছিলো নবম সেক্টরের অধীন। আর এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। নবম সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধ, সম্মুখ যুদ্ধ, ট্যাঙ্ক যুদ্ধ ইত্যাদি প্রয়োজনমত সব যুদ্ধের মাধ্যমেই শত্রুদের মোকাবেলা করে। খুলনা জেলার বিভিন্ন স্থানে তারা অসমসাহসীকতার সাথে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধটি সংঘটিত হয় খুলনা শহরের অদূরে শিরোমনিতে। খুলনা শহরের উপকন্ঠে খুলনা-যশোর রোডের পাশে শিরোমনির অবস্থান। এখানে যুদ্ধ সংঘটিত হয় মুক্তিযুদ্ধের একেবার শেষের দিকে, অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে। এখানে সংঘটিত যুদ্ধ ‘শিরোমনি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ’ নামেই সমধিক পরিচিত। এই যুদ্ধ এতটাই রোমাঞ্চাকর ও আলোচিত ছিলো যে, এই যুদ্ধের কৌশল পৃথিবীর বহু দেশের সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা কলেজে সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করে পড়ানো হয়।
৭ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হলে পাকবাহিনীর কমান্ডার হায়াত খান তার বাহিনী নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে খুলনা অভিমুখে যাত্রা করেন। এই বাহিনীর সাথে ছিলো বিশাল ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, পদাতিক সেনা, রাজাকার বাহিনী-সব মিলিয়ে বিশাল এক বাহিনী। এই বাহিনী খুলনা শহরের উপকন্ঠে শিরোমনি এলাকায় ঘাঁটি গাড়ে। শিরোমনি ছাড়াও পার্শ্ববর্তী আটরা, গিলাতলা, তেলিগাতি, দৌলতপুর, শোল গাতিয়া প্রভৃতি স্থানে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে এবং শক্তিশালি প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তোলে। তারা শিরোমনি এলাকায় যশোর রোডের বিভিন্ন স্থানে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাখে। ১৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর মেজর মহেন্দ্রসিং ও মেজর গনির নেতৃত্বে একটি বড় সেনা দল খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি পাকবাহিনীর অবস্থান ও গতিবিধি বোঝার জন্য গোলা বর্ষণ করতে করতে এগোতে থাকে। কিন্তু প্রতিপক্ষের কোন সাড়া না পেয়ে অনেকটা নিশ্চিন্তে খুলনা শহরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু বহরটি শিরোমনি এলাকায় পৌঁছানোর সাথে সাথে ঘাপ্টি মেরে থাকা পাকবাহিনী চারিদিক থেকে মিত্র বাহিনীর সৈনদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। এই আকস্মিক হামলায় মিত্রবাহিনী প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয়। তাদের অনেক সৈন্য হতাহত হয়। অবশিষ্ট সৈন্যদল পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ফুলতলার কাছাকাছি চৌদ্দগ্রাম ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।
এরপর নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী চৌদ্দগ্রাম ক্যাম্প থেকে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর, ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, যৌথভাবে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। মূলত মেজর মঞ্জুর সাহসী নেতৃত্ব, তার প্রজ্ঞাদিপ্ত রণকৌশল এই যুদ্ধ জয়ের অন্যতম কারণ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর রাতে মেজর জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে একটি দল খুলনা শহরের পূর্বদিকে চক্রাখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে আক্রমণ করতে করতে গল্লামারি রেডিও সেন্টার অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। তখন রেডিও সেন্টার পাহারারত পাকবাহিনীর সাথে জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াই হয় এবং সকাল নাগাদ পাকবাহিনী পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করে। বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা দলটি বীরের বেশে খুলনা শহরে প্রবেশ করে এবং মেজর জয়নুল আবেদিন ও লেঃ গাজী রহমতউল্লাহ দাদু সকাল ৯ টায় সার্কিট হাউসে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
অন্যদিকে ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর দুই দিন ধরে মেজর মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন বাহিনী অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ করে শিরোমনি এলাকার চারিদিক থেকে পাকবাহিনীকে ঘিরে ফেলে। মিত্রবাহিনীর আর একটি দল ভৈরব নদ পার হয়ে শিরোমনির ঠিক পূর্বদিকে অবস্থান নিয়ে পাকবাহিনীর ওপর বিরামহীন গোলাবর্ষণ করতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর রাতে মেজর মঞ্জুর বাহিনী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেজর মঞ্জু রাতের অন্ধকারে লুঙ্গি পরে গেঞ্জি গায়ে দিয়ে এবং মাথায় গামছা বেঁধে দুই হাতে দুটি স্টেনগান নিয়ে পাকবাহিনীর ট্যাঙ্ক বহরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি অসীম বীরত্বে প্রতিটা ট্যাঙ্ক থেকে একজন করে গানম্যানকে হত্যা করে শত্রু পক্ষের ট্যাঙ্ক বহরকে স্তব্ধ করে দেন। এটাই ছিলো ওই যুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। সারারাত ধরে যুদ্ধ চলে। তবে যতই ভোর হতে থাকে, পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ততই স্পষ্ট হতে থাকে। ১৭ তারিখ ভোরে পাকবাহিনীর কমান্ডার হায়াত খান প্রায় চার হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে শিরোমনি নসু খানের ইট ভাটার কাছে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে ১৭ তারিখ সকাল থেকেই খুলনা শহরের চতুর্দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ সার্কিট হাউজ মাঠের দিকে ছুটতে থাকে। বিজয়ী মানুষের জয় বাংলা শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। বেলা দেড়টা নাগাদ মিত্রবাহিনীর মেজর দলবীর সিং, মেজর মঞ্জু ও মেজর এম এ জলিলের কাছে পাক সেনা কর্মকর্তা হায়াত খান আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত দলিলে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এরই সাথে জাতীয় বিজয়ের একদিন পর, অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর খুলনা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়।
সুতরাং বাঙালির গৌরব গাঁথা বিজয়ে খুলনার মানুষের সাহস, তাদের অবদান, তাদের আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয়। এই অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায় ( তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়)।
লেখক : সন্তোষ দাস, শিক্ষক