দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক: আজ মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ,৭৫ এর ট্রাজেডী ইত্যাদি নানা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিসিঞ্জারের নাম। হেনরি কিসিঞ্চার জাতির পিতাকে নিয়ে কি ভাবতেন, তার একটি চিত্র পাওয়া যায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ সংবাদিক ও লেখক ‘মিজানুর রহমান খানে’র ‘১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল’ গ্রন্থে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে ঐ লেখটি পূণ:প্রকাশ করা হলো-
কিসিঞ্জার মনে করেন, মুজিব ৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে একটু কৌশলী হন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর মতোই শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীনতার দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। ৭ মার্চে মুজিব পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই একটি সংঘাত এড়িয়ে গেছেন। ১৩ মার্চে নিক্সনকে দেওয়া এক স্মারকে এ মন্তব্য করেন কিসিঞ্জার। কিন্তু তিনি বলেন যে, আপাতত শোডাউন এড়ানো গেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কোনে ধরনের সমঝোতা ও নিষ্পত্তির প্রশ্নটি আগের মতোই রয়ে গেছে নাজুক।
কিসিঞ্জার লিখেছেন, ইসলামাবাদে আমাদের দূতাবাসের বিশ্বাস মুজিব তার লক্ষ্যে অটল থেকেছেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃত্ব থেকে পূর্ব পাকিস্তানের 'বন্ধনমুক্তি' চেয়েছেন। তবে এখনো একটি অখণ্ড পাকিস্তানের মধ্যে তিনি 'পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন' মেনে নিতে পারেন বলে গণ্য করা যেতে পারে। এ কথাও টিক যে, মুজিবুর রহমান নিশ্চিতভাবেই এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছেন যে, যে স্বাধীনতা তিনি চেয়েছেন তা শুধুই সরাসরি স্বাধীনতার দাবি জানানোর পথেই অর্জিত হতে পারে। ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করলে এমনটা প্রতীয়মান হয় যে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তিনি এটি এড়াতে চেয়েছেন।
তার ধারণা তিনি ধীরে ধীরে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তার লক্ষ্য অর্জন করবেন। আর এই প্রক্রিয়াতেই একতরফা স্বাধীনতাদানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। বর্তমানের এই জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের আরেক চরিত্র হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতা জেড এ ভুট্টো। এই মুহূর্তে তিনি নীরব রয়েছেন। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ডাকা গণপরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে অস্বীকার করে তিনি বর্তমান সংকটকে ঘনীভূত করেছেন। যনি গণপরিষদ আহ্বান করা সম্ভব হয় তাহলে ভুট্টো ও রহমানের মধ্যে কেন্দ্র এবং প্রদেশের ক্ষমতার বণ্ঠন প্রশ্নে অন্তত কাগজে-কলমে হলেও একটা সুরাহা হতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলে, ভুট্টো ও রহমান এই মুহূর্তে সংকট অবসানে সত্যিই কতটা আন্তরিক হবেন। কিসিঞ্জার তার স্মারকে উক্তরূপ বর্ণনা দানের পর মন্তব্য করেন যে, ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় কোনো রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে এগিয়ে আসে কি না তা সামনের দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে। ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শিগগিরই ঢাকা যাচ্ছেন। যেসব পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে হলো।
১. ইয়াহিয়া হয়তো রহমানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেবেন। হয়তো বড় জোর রহমান ও অন্য নেতাদের গ্রেফতার করবেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে একটা সামরিক সমাধান থেকে নিজেকে সংযত রাখবেন। এক্ষেত্রে দুটো সমস্যা আছে। প্রথম, রহমান-গান্ধী আদলে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন। সে কারণে ইয়াহিয়া যে সামরিক আক্রমণ চালাবেন তার যথার্থতা দেওয়া কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর রয়েছে সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা। তারা একটি প্রলম্বিত জনবিদ্রোহকে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না।
২. একটা নিশ্চল অপেক্ষার খেলার উদ্ভব ঘটতে পারে। সেনাবাহিনী অথবা বেসামরিক কোনো তরফেই অচল অবস্থা নিরসনে কোনো সাহসী পদক্ষেপ নেয়া হবে না। উভয়পক্ষ আশা করবে অন্যপক্ষ এটা ভাঙতে আগে এগিয়ে আসবে। সম্ভবত মুজিব এবং আমরা বর্তমানে ঠিক এই ধরনের একটি বাস্তবতার মুখোমুখি। এই অবস্থা থেকে শক্তি প্রয়োগের ঘটনা ছাড়াই পর্যায়ক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে মুজিব সক্ষম হবেন।
৩. ইয়াহিয়া, রহমান অথবা ভুট্টো অধিকতর কৌশলগত রাজনৈতিক চাল দিতে পরেন। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটুও না ছাড় দিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে পারেন। সংক্ষেপে পাকিস্তানের সংকট অবসানের কোনো লক্ষণ নেই। বরং তা হঠাৎ জ্বলে উঠতে পারে। আপনি জানেন গত শনিবার ৬ মার্চ সিনিয়র রিভিউ গ্রুপ বৈঠকে বসেছিল। লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ভূমিকা উত্তরণ। ঐ বৈঠকে সাধারণভাবে সবাই একমত হয়েছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ তেমন কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবে না। তাই উৎকৃষ্ট পন্থা হলো নিষ্ক্রিয় থেকে ঘটনার পর্যবেক্ষণ করা। আমি বলতে চাইছি, আমাদের একেবারে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে যাতে ইয়াহিয়া আপত্তিকর কিছুই না দেখতে পায়।
কিসিঞ্জার নিক্সনকে স্পষ্টই এ কথা উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান এখন একটি রক্তস্নাত গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। এই অকম্ধায় যুক্তরাষ্ট নিম্নোক্ত কারণে নীরবতা পালন করে যাবে। প্রথমত, ইয়াহিয়া জেনে এসেছেন, আমরা অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে। সুতরাং এখন এই অবস্থান নাটকীয়ভাবে বিসর্জন দেওয়া যায় না। ইয়াহিয়া আরো জানেন, একটি রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য আমরা সম্ভব সব চেষ্টা করে যাচ্ছি। দ্বিতীয়ত, এ কথা সত্য যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির প্রতি আমদের প্রভাব যত সামান্য। আর সে কারণে আমাদের হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছিত। এখন আমরা কিছু করতে গেলেই তা পশ্চিম পাকিস্তানিদের অসন্তুষ্টি করবে। ভবিষ্যতে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তারা অভিযোগ করবে আমরা অনধিকার চর্চা করছি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমরা যদি এখন এই অবস্থান গ্রহণ করি তাহলে পূর্ব পাকিস্তান যদি কোনোদিন স্বাধীন হয় তাহলে আমাদের ভূমিকাকে তারা সুনজরে দেখবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন রাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
এর পরের দলিলটি ১৫ মার্চ '৭১ এ লেখা। স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী সিসকো লিখেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী রজার্সকে। এই তথ্য স্মারকের শিরোনাম 'মুজিব নিয়ে নিলেন-পূর্ব পাকিস্তান; ইয়াহিয়া উড়ে গেলেন- ঢাকায়।
'শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঢাকায় ঘোষণা করেছেন, তার দল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। কারণ প্রাদেশিক পরিষদে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৩০০ আসনের ২৮৮ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। মুজিব পদক্ষেপ নেন একতরফাভাবে এবং ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইন প্রশাসনকে উপেক্ষা করেই। সত্যি কথা হলো, মুজিব যে পঁয়ত্রিশ দফা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা খুবই পরিকল্পিত ও সতর্কতার সঙ্গে। এই পদক্ষেপের তাৎপর্য হচ্ছে, মুজিব ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিরোধে জড়িয়ে পড়লেন ঠিকই কিন্তু একই সঙ্গে তিনি শর্তহীনভাবে একতরফা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে দূরে সরে থাকলেন। এখন ইয়াহিয়ার সামনে বিকল্প হচ্ছে ইতোমধ্যেই বিপন্ন হওয়া অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব আরো হুমকিগ্রস্ত করবেন কি করবেন না? সেক্ষেত্রে ইয়াহিয়া তার সামরিক আইনের ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন অন্তত পূর্ব পাকিস্তান থেকে।
অবশ্য একই সঙ্গে তা আবার পশ্চিম পাকিস্তানে বহাল রাখা কঠিন হবে। ইয়াহিয়া এবং সামরিক বাহিনীর অন্যরা যদি সিদ্ধান্ত নেন যে, মুজিবকে তারা শক্তি দিয়ে প্রতিহত করবেন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হবে। আর তার পরিণতিতে বাংলার স্বাধীনতা হবে অনিবার্য। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সব প্রকারের বন্ধন ছিন্ন হবে। ভরসা একটাই যদি দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখা সম্ভব হবে না, তা হলো সেনাবাহিনী সাফল্যের সঙ্গে অভ্যুত্থান দমাতে পারে। মুজিব তার ভাষণে বাঙালিদের ওপর যদি শক্তি প্রয়োগের কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে ‘যার যা কিছু আছে’ তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানিয়েছেন।
১৪ মার্চ করাচিতে ভুট্টো উভয় অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছেন। যার অর্থ হলো ভুট্টোকে পশ্চিমে আর মুজিবকে পূর্বে। সিসকো এ পর্যায়ে মন্তব্য করেন, ভুট্টোর ভাষণ প্রকারান্তরে মুজিবের গৃহীত পদক্ষেপকেই উস্কে দিতে পারে। এটা কিন্তু বেশ কিছু সমর ধরে সন্দেহ করা হয়েছে যে, ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, পাকিস্তান যদি দুটুকরো বা তার কাছাকাছি কিছু হয়, তাহলেই ভুট্টো পশ্চিমাংশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন। ভুট্টোর অবশ্য মুজিবের মতো পন্থা অনুসরণ কঠিন। কারণ, পশ্চিমে সেনাবাহিনী খুবই শক্তিশালী এবং তারা সম্ভবত সেখানে কোনো বিদ্রোহ হলে তা সাফল্যের সঙ্গে স্তব্ধ করতে পারবে। এই দলিলের শেষ মন্তব্য পাকিস্তানে যেসব ঘটনা খাঁজে তাতে অখণ্ড পাকিস্তানে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ইয়াহিয়া এখন কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।
(১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল (পৃষ্ঠা: ১৩৮-১৮১)
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।