আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৩) জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতি যতো আলোচিত হচ্ছে ইতোপূর্বকার কোন মুদ্রানীতিই ততোটা আলোচিত হয়নি। এর প্রধান কারণ, মুদ্রানীতিতে শুধু মুদ্রাসরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টি না রেখে মুদ্রানীতি হারের উপর জোর দেয়া হয়েছে। ফলে এই নীতি সব ব্যাংক, লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান এবং টাকা-ডলার বিনিময় হার নিয়ে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত মহলের সামনে এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তারা এখন এই পরিস্থিতির সাথে কিভাবে খাপ খাওয়ানো যায় তার পন্থা নির্ধারণ করতে লেগেছেন।
যদিও সুদ নীতি হার বাজার ব্যবস্থার উপর ছেড়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন মহলের দীর্ঘকালের দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছেন এবং আশা করছেন এই নীতি হার বাস্তবায়ন শুরু হলে টাকা ও ডলারের বিনিময় হার যৌক্তিক পর্যায়ে পৌঁছুবে, যা অর্থনীতিতে স্থীরতা আনতে সহায়ক হবে, যা এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। তবে অভিজ্ঞ ব্যাংকাররা এবং মুদ্রানীতি বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ঘোষিত মুদ্রানীতি দেশের আর্থিক পরিস্থিতি স্থীতিশীল করতে খুব বেশী ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে না, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে খুব বেশী সফল হবে না।
কারণ হিসাবে তারা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সেখান থেকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে যে সব পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিলো মুদ্রানীতিতে তার বিষদ উল্লেখ নেই।
মুদ্রানীতির প্রধানতম লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা (বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কমানো)। এছাড়াও রয়েছে দেশি ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার যেনো যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সে দিকে লক্ষ্য রাখা এবং কর্মসৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখা। বাজারের গতি-প্রকৃতির উপর টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছেড়ে দিয়ে যে উদ্যোগ মুদ্রানীতিতে রাখা হয়েছে তাতে ব্যাংক ও আমদানি-রফতানি সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়েছে ঠিকই, তবে এই উদ্যোগ তার ইপ্সিত লক্ষ্যে কতোদূর এবং কতোদিনে পৌঁছুবে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে অভিজ্ঞ মহলের।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন কোনো পদক্ষেপ পৃথকভাবে চিন্তা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। বারংবার সেই পুরানো কথা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু একটি কথা বলা হচ্ছে না, তা হচ্ছে বিশ্ববাজারে ইতোমধ্যে বহু পণ্যের দাম কমেছে, জ্বালানি তেলসহ। তার প্রভাব বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং অন্যান্য পণ্যের দাম ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এর কোনো যৌক্তিক কারণ বোঝা যাচ্ছে না। তবে বাজার অভিজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা আমাদের দেশের সরবরাহ ব্যবস্থা বা ‘সাপ্লাই চেনের’ মধ্যে রয়েছে। সাপ্লাই চেইনে যদি কোনো প্রকার ‘মন্দ ইন্টারভেনশন’ হয় তবে তার প্রভাব অবশ্যই দ্রব্যমূল্যের উপর পড়বে এবং পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশে এ রকম ঘটনা প্রায়শই ঘটে। এখানে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন নিবিড় মনিটরিং এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতিতে মনিটরিং এর বিষয়টি তেমনভাবে আসে নি।
মুদ্রানীতিতে কটেজ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের সমর্থনে যে সুদ হারের কথা বলা বা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা কর্মসৃজনে যতোদূর সহায়ক হবে, সে বিষয়ে সব মহলেই সন্দেহ রয়েছে।
উল্লেখ্য, কর্মসৃজন বিষয়টিকে পূর্বের মুদ্রানীতিগুলোতে সবসময় জোর দেয়া হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট সর্বমহলেই মুদ্রানীতি কতখানি কার্যকর (সফল) হবে সে ব্যাপারে শক্ত সন্দেহ রয়েছে।
লেখক : মনোয়ার হোসেন, উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা