মেধা পাচার ও প্রাসঙ্গিক কথা

ইমরান ইমন |

বেশ নীরবেই দেশ থেকে ‘মেধা পাচারের বিপ্লব’ ঘটে যাচ্ছে। অথচ সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই! মেধাবী তরুণ প্রজন্ম নিয়ে কারও চিন্তার সময় নেই। সবাই শুধু ক্ষমতা দখলের চিন্তা, ক্ষমতা চর্চার চিন্তা আর দেশকে লোপাট করার চিন্তায় মশগুল। প্রতিযোগিতাটা এমন-কে কার রেকর্ড ভাঙবে!

অথচ তরুণ প্রজন্ম একটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। তরুণ প্রজন্মের সঠিক পরিচর্যা ও তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ এবং মূল্যায়নের ওপরই নির্ভর করে একটা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কেমন হবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে তরুণ প্রজন্ম মেধাবী প্রজন্ম সেভাবে পরিচর্যা পায় না, পায় না তার কাঙ্ক্ষিত মূল্যায়নও। এখানে মেধাবী হয়েও সে তার মেধার মূল্যায়ন পায় না। অথচ তার চেয়ে কম যোগ্যতার কেউ একজন পলিটিক্যাল লবিং বা ঘুষবাণিজ্যের মাধ্যমে তার কাঙ্ক্ষিত যোগ্য আসনটি দখল করে নিচ্ছেন। এমন ঘটনা তখন স্বাভাবিকভাবেই একজন মেধাবীর পক্ষে মেনে নেওয়ার কথা নয়। সাম্প্রতিককালে আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগগুলোর দিকে তাকাই তখন বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেখা যায়, লবিং ও ঘুষবাণিজ্যের মাধ্যমে মেধাবী যোগ্যজনকে নিয়োগ না দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় অযোগ্যজনকে। এদেশে এমন ঘটনা এখন গণমাধ্যমের শিরোনামও হয়।

একজন মেধাবী যখন দেখেন তিনি তার মেধা-যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন পান না কিংবা তার চেয়ে কম যোগ্য, অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্য কেউ একজন যখন সে সুযোগ-মূল্যায়ন পেয়ে বসেন, তখন যৌক্তিক কারণেই তিনি সেটা মেনে নিতে পারেন না। ফলে সিস্টেমের প্রতি সার্বিকভাবে দেশের প্রতি তার একটা অনীহা জন্মে যায়। তখন তিনি দেশ ত্যাগে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটার কালজয়ী কথা মনে পড়ছে: 'যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।'

মেধাবীদের দেশ ত্যাগের সংখ্যা দিনদিন হুঁ হুঁ করে বেড়ে চলছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন মোট ৫২ হাজার ৭৯৯ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী। যা এদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ! এদের বেশিরভাগই পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের উচ্চশিক্ষার পছন্দের দেশের তালিকায় রয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, মালয়েশিয়া এবং জার্মানির মতো দেশে। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, চাকরির বাজারে নৈরাজ্য, বিষয়ভিত্তিক বিষয়ের চাকরির বাজার না থাকা, মেধার সঠিক মূল্যায়ন না হওয়া—এসব কারণেই মেধাবী তরুণ প্রজন্ম দেশ ছাড়ছেন হুঁ হুঁ করে। ফলে আমাদের মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে কার্যকরভাবে। আর মেধা পাচার হয়ে গেলে মেধাবী মানুষরা দেশে না থাকলে দেশের পরিস্থিতি কেমন হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

যেসব মেধাবী তরুণ-তরুণী দেশ ছাড়ছেন, বিশেষ করে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন তাদের পেছনে সরকারের একটি ব্যয় রয়েছে। সরকার কি কোনোদিন সে হিসেব করেছে যে—আমার এ বিনিয়োগের আউটকাম কী?

আমরা দেখি, আমাদের পাশের দেশ ভারতের মেধাবী তরুণ-তরুণীরা যখন বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যান তখন রাষ্ট্র থেকে একটা কমিটমেন্ট নির্ধারিত থাকে যে, উচ্চশিক্ষা শেষে সে যেন দেশে ফিরে আসে এবং অর্জিত উচ্চশিক্ষা যেন সে তার দেশের উন্নতিতে সমৃদ্ধিতে কাজে লাগায়। এবং বিদেশগামী সেসব মেধাবীরা উচ্চশিক্ষা শেষে দেশেই ফিরে আসে এবং অর্জিত জ্ঞান দেশের কল্যাণে কাজে লাগায়। এ কারণেই ভারত সব দিক থেকে এখন এগিয়ে যাচ্ছে এবং পরাশক্তির কাতারে নাম লিখাচ্ছে। তারা বুঝতে পেরেছে—মেধাবীদের মূল্যায়ন ব্যতীত কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধ দেশ গড়া সম্ভব নয়। আমাদের দেশ কি সেটা বুঝেছে? 
সবমিলিয়ে মেধা পাচারের মাত্রাটা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। এভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই মেধাশূন্য হয়ে ওঠবে। এখনই এর লাগাম টেনে ধরতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037808418273926